শ্রী শ্রী দুর্গা মায়ের তত্ত্বকথা
বিজন কুমার বৈশ্য
শ্রী শ্রী মা দুর্গা আসছেন। মায়ের আগমনী গানে আমাদের হৃদয় আন্দোলিত, আমরা উদ্বেলিত। আসুন মায়ের কথা একটু জেনে নেই। মন্দিরে মন্দিরে মা সবার মাঝে অধিষ্ঠিত। মায়ের ডানে লক্ষ্মী ও গণেশ, বামে স্বরস্বতী ও কার্তিক, চরণতলে সিংহ, সম্মুখে অসুর আর বাম প্রান্তে কলাবউ। এই মোট আট জনের প্রত্যেকেরই বিশেষ গুণ ও ক্ষমতা রয়েছে।
অসুরকে বধ করার জন্য দেবী হলেন মা দুর্গা। জীবকে দুর্গতি দেওয়া দুর্ধর্ষ অসুরের কাজ, তাকে বধ করে মা জীবের দুর্গতি দূর করেন। স্বার্থান্ধতায় মজে জীব দুঃখ ভোগ করে, আবার অবিদ্যার অধীন হয়ে মায়ার জালে জড়িয়ে সীমাহীন দুর্দশা ভোগ করে। মা জ্ঞান অসি দ্বারা অবিদ্যার বন্ধন দূর করেন। দুর্গার আরেক অর্থ দুর্জ্ঞেয়। মায়ের কৃপা ছাড়া তাকে জানা যায় না, তাই মা দুর্জ্ঞেয়। মা অসংখ্য হাত দ্বারা সন্তানদের পালন করেন। মূর্তিতে মায়ের দশ হাত। দশ হাতে দশটি অস্ত্র। ডান দিকের উপর থেকে নিচের দিকে পাঁচ হাতে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, তীক্ষè বাণ, শক্তি বাম দিকের পাঁচ হাতে রয়েছে খেটক (ঢাল), ধনু, পাশ, অঙ্কুশ, ঘণ্টা (কুঠার)। প্রতিটি অস্ত্রই আধ্যাত্মিক অর্থ বহন করে। যেমনÑ ত্রিশূল দ্বারা স্থুল, সূক্ষ্ম ও কারণ জীবের এই তিন প্রকার দেহ লয় করে সিদ্ধ দেহ জাগিয়ে দেন। আবার খড়গ হলো তত্ত্বজ্ঞানের অসি; যার দ্বারা সাধকের অজ্ঞানতা নাশ করেন। প্রতিটি অস্ত্রের ব্যবহারিক ও পারমার্থিক অর্থ রয়েছে। পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মতো মা ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন। মায়ের বাম চরণ, কটি ও গ্রীবা ঈষৎ বাঁকানো। মায়ের ডান চরণ রেখেছেন সিংহের পীঠে সরলভাবে, বাম চরণ অসুরের স্কন্ধ পরে বা বক্ষ পরে। ব্রহ্মাণী রূপে মা সৃষ্টি করেন, বৈষ্ণবী শক্তি রূপে মা পালন করেন; আবার শিবানী শক্তি রূপে পরিণতি সাধন করেন। মায়ের মুখম-লে শিব, বাহুতে বিষ্ণু, চরণে ব্রহ্মা, কেশে যম, কটিতে ইন্দ্র, স্তনযুগলে চন্দ্র, উরুতে বরুণ, নিতম্বে পৃথিবী, নাসিকায় কুবের, পদাঙ্গুলিতে সূর্য, করাঙ্গুলিতে বসুগণ, ত্রিনয়নে অগ্নি রূপে মা নিখিল দেবগণের শক্তিসমূহের অধিষ্ঠাত্রী। সবই দেবী হতে প্রকাশিত, আবার তাতে অন্তর্হিত। তাই দুর্গা বিশ্বেশ্বরী, জগৎজননী, পরমেশ্বরী।
লক্ষ্মী সমুদ্র সম্ভবা। সমুদ্রমন্থনে রতœ মিলবেই, বিশ্ব প্রকৃতি সমুদ্রের মতো। জীবের জীবিকার উৎস লক্ষী দেবী। ইনিই স্বর্গলক্ষ্মী, রাজলক্ষ্মী, গৃহলক্ষ্মী। যার ভা-ারে ধন নেই সেও লক্ষ্মীছাড়া। সাধকের মুক্তি ধনো লক্ষ্মী। আবার শাপ গ্রস্ত হয়ে নদী রূপে তিনি পদ্মা। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। পেঁচা দিবান্ধ। ধনশালী হলে অনেকেই পেঁচার মতো দিবান্ধ হয়ে যান।
গনেশ শঙ্খ চক্র-গদা পদ্মধারী। গণেশ শ্রী বিষ্ণুর অংশ। পার্বতীর আরাধনার কারণে শ্রী বিষ্ণুই গনেশ রুপে মায়ের সন্তান। শনি সীমাবদ্ধতার প্রতীক। শনির দৃষ্টিতে গনেশ শির হারান। ঐরাবতের মাথা সংযোজন করা হয় গনেশের মাথায়। গণেশের বাহন ইঁদুর। মাথা হাতির অথচ বাহন ক্ষুদ্র ইঁদুরের। এটা হলো ছোটর সঙ্গে বড়র মেলবন্ধন, অভিজাতের সঙ্গে সাধারণের মিলন ।
দেবী স্বরস্বতী বাগদেবী, জ্ঞানশক্তি যার হাতে পুস্তক ও বীণা। পুস্তক বেদ যা শব্দব্রহ্ম বীণা সুরছন্দ তথা নাদব্রহ্ম। শুদ্ধ স্বত্ব গুণের দেবী সরস্বতী সর্বশুক্লা। শ্বেত বর্ণ একটি ভাবের প্রকাশক। সরস্বতীর বাহন শ্বেত হংস। হংস যেমন জল-দুধ থেকে শুধু দুধ গ্রহণ করে তেমনি সাধক অসার অংশ বাদ দিয়ে নিত্য সার অংশ গ্রহণ করে। হংস যেমন জলে থাকলেও জল তার গায়ে লাগে না, তেমনি পরমহংস সাধক সংসারে বাস করলেও সংসারিক মায়া তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
কার্তিক ক্ষাত্র শক্তির অধিকারী। হর-পার্বতীর তপস্যালব্ধ সন্তান হলো দেব সেনাপতি কার্তিক। সরস্বতী জ্ঞানমূর্তি তাই ব্রাহ্মণ্য শক্তি, লক্ষ্মী বৈশ্য শক্তি, কার্তিক ক্ষাত্রশক্তি, গনেশ গণশক্তি। সরস্বতী দিবেন নীতি, লক্ষ্মী দিবেন ধন, গণেশ দিবেন শ্রম আর কার্তিক দিবেন পরাক্রম। কার্তিক যুব শক্তির প্রতিক। কার্তিক পুত্রদাতা। কার্তিকের বাহন ময়ূর।
সিংহ রাজগুণের প্রতীক। মা দুর্গা শুদ্ধা স্বত্বগুণময়ী, আর অসুর ঘোর তমগুণ সম্পন্ন। মায়ের সঙ্গে অসুরের যুদ্ধ স্বত্বগুণ ও তমগুণ এর লড়াই। অসুর (আসু-প্রাণ) যার মধ্যে প্রাণ শক্তির প্রাচুর্য আছে। অসুর সুর-বিরোধী। কাজেই যার মধ্যে প্রাণ শক্তির প্রাচুর্য আছে কিন্ত তা অসৎ উদ্দেশ্যে পরিচালিত সেই অসুর। সুর-অসুর সংঘর্ষ সর্বত্রÑ আমাদের অন্তরে, সমাজে, দেশে দেশে দেব শক্তি ও অসুর শক্তির বিরোধ চলছে। মা অসুরকে বিনাশ করতে, আমাদের দম্ভ, দর্প, অজ্ঞানতা ইত্যাদি দূর করে আমাদের শুভ পথে আনতে যদি আঘাতও করেন তাও কল্যাণের জন্যই করেন। কলাবউ যার শাস্ত্রীয় নাম নবপত্রিকা যাতে নয়টি গাছের চারা থাকে-কদলী, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী বেল, দাড়িম, অশোক, মান, ধান। শ্বেত অপরাজিতা দিয়ে এই নয়টি চারা বেঁধে কলাবউ সাজানো হয়। প্রতিটি চারার এক একজন অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেনÑ কদলীতে ব্রহ্মাণী, কচুতে কালিকা, হরিদ্রাতে দুর্গা, জয়ন্তীতে কার্তিকী, বেলে শিবা, দাড়িম্বে^ রক্তদন্তিকা, অশোকে শোকরহিতা, মানে চামু-া ও ধানে লক্ষ্মী। এদের প্রতিটির যুক্তি যুক্ত কারণ রয়েছে। দ্রষ্টা ঋষিরাই এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন। যেমন কদলী যতবার কাঁটা হয় ততবার গজায়। অর্থাৎ কদলির সৃজনী শক্তি অফুরন্ত। আবার ব্রহ্মাণী হচ্ছেন সৃজনীশক্তি। লেখক: সরকারের অতিরিক্ত সচিব
কাজেই কলাবউ এ কদলী থাকা একটি গভীর তত্ত্বের ইঙ্গিতবহ। সমষ্টিগতভাবে মা দুর্গার প্রতিনিধি রূপে নবপত্রিকার পূজা করা হয়।
রম্ভাসুর ও মহিষীর সন্তান, মহাবলশালী মহিষাসুর যখন দেবতাদের জয় করে স্বর্গ রাজ্য অধিকার করেন, তখন স্বর্গচ্যুত দেবতাদের আবেদনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও অন্যান্য দেবতাদের ক্রোধান্বিত তেজ একত্রিত হয়ে হিমালয়ে কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে (মহালয়ার পূর্বদিন) দেবীর আবির্ভাব ঘটে। ষষ্ঠী পর্যন্ত বিল্বমূলে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করার পর ব্রহ্মা সপ্তমীতে মৃন্ময়ী মূর্তিতে দেবীর আবাহন করা হয়। অষ্টমী নবমীর সন্ধিক্ষণে বিশেষ পূজার পরে নবমী পূজা। দশমীতে দেবীর বিসর্জন।
দুর্গাপূজার ভাবগত অর্থ হলোÑ অশুভ শক্তির বিনাশ করা, সেটা হতে পারে অন্তরের অশুভ রিপু কিংবা পার্থিব অশুভ শক্তি। তাই আসুন শুধু বাইরের ঠাট বজায়ে ব্যস্ত না থেকে, অন্তসারশুন্য বিবেকহীন না হয়ে, নিষ্ঠা ও ভক্তির সঙ্গে মায়ের পূজা করি। মায়ের মন্দিরে এমন কোনো নাচ, গান, মিউজিক বা আচরণ না করি যা মনকে নির্মলতা, প্রসন্নতা না দিয়ে বরং মনকে অনিয়ন্ত্রিত করে দেয়। মায়ের পূজা যেন ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যতাকে ছাপিয়ে শুধু আনন্দ উৎসবে পরিণত না হয়। আসুন সবাই মিলে এই প্রর্থনা করি, মা তুমি অশুভ শক্তি বিনাশ কর, তুমি আমাদের শক্তি প্রদান কর যাতে আমরাও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারি।