কুমারী পূজা
সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মহাষ্টমী দেবীর সন্ধিপূজা এবং রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতে কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। মাতৃভাবে কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা করে তাতে জগজ্জননীর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন কুমারী কন্যাকে। দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুমারী পূজা। শাস্ত্র অনুসারে সাধারণত এক বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলণা কুমারীকে পূজার উল্লেখ রয়েছে। অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে। বয়স ভেদে কুমারীর নাম হয় ভিন্ন। নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। হাতে দেওয়া হয় ফুল, কপালে সিঁদুর এবং পায়ে আলতা। ঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। কালের অতলে দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা হারিয়ে গেলেও স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ১৯০১ সালে বেলুর মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদাদেবীর অনুমতিক্রমে কুমারী পূজা পুনঃপ্রচলন করেন। তবে সব দুর্গাপূজার ম-পে কুমারী পূজা হয় না। সাধারণত রামকৃষ্ণ মিশনের কিছু কিছু শাখায় এ পূজা মহাষ্টমীর দিনে অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও বরিশাল এর মধ্যে অন্যতম।
শাস্ত্রীয় ধারণা: বৃহদ্ধর্মপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চ-িকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। তবে অনেকে মনে করেন যে, দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনা মতে। এক সময় শক্তিপীঠ সমূহে কুমারী পূজার রীতি প্রচলিত ছিল। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও কুমারীর কথা উল্লেখ আছে। আর এ থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে, দেবীর কুমারী নাম অনেক পুরনো। যোগিনীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্য, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্যসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যেকোনো কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। কিন্তু অবশ্যই তাদের ঋতুবতী হওয়া চলবে না।
ধর্মের বিধান অনুযায়ী এক এক বয়সের কুমারীর এক এক নাম রয়েছে। এক বছরের কন্যার নাম সন্ধ্যা, দুই বছরের কন্যার নাম সরস্বতী, তিন বছরের কন্যার নাম ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কন্যার নাম কালীকা, পাঁচ বছরের কন্যার নাম সুভাগা, ছয় বছরের কন্যার নাম উমা, সাত বছরের কন্যার নাম মালিনী, আট বছরের কন্যার নাম কুব্জিকা, নয় বছরের কন্যার নাম কালসন্দর্ভা, দশ বছরের কন্যার নাম অপরাজিতা, এগার বছরের কন্যার নাম রুদ্রাণী, বার বছরের কন্যার নাম ভৈরবী, তের বছরের কন্যার নাম মহালক্ষ্মী, চৌদ্দ বছরের কন্যার নাম পীঠনায়িকা, পনের বছরের কন্যার নাম ক্ষেত্রজ্ঞা ও ষোল বছরের কন্যার নাম অম্বিকা।
দার্শনিক তত্ত্ব: কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলোÑ নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্ব ব্রহ্মা-ে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধন পদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তিস্বরূপ ধারণ করে। তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
কুমারী ভগবতীর দেবী দুর্গার সাত্ত্বিক রূপ। জগন্মাতা বিশ্বব্রহ্মা-ের সৃষ্টিকর্ত্রী হয়েও চিরকুমারী। কুমারী আদ্যাশক্তি মহামায়ার প্রতীক। দুর্গার আরেক নাম কুমারী। মূলত নারীর যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতেই কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়। মাটির প্রতিমায় যে দেবীর পূজা করা হয়, তারই বাস্তবরূপ কুমারী পূজা। কুমারীতে সমগ্র মাতৃজাতির শ্রেষ্ঠ, শক্তি, পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তি, সকল কল্যাণী শক্তি সূক্ষ্মরূপে বিরাজিতা।