সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিরসনে বৈদিক দর্শন
শ্রী চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের করাল গ্রাসে সমগ্র বিশ্ব আক্রান্ত। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত চলছে সন্ত্রাসী আগ্রাসনের তা-ব নৃত্য। দিশেহারা সাধারণ মানুষ অস্তিত্বের সংগ্রামে লড়ছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ভয়ানক হামলা জনমনে ছড়িয়ে দিয়েছে অশান্তির বিষবাষ্প। তবে কালের প্রবাহে এরকম ঘটনা নতুন কোনো ঘটনা নয়। যুগে যুগে অন্যায়, অত্যাচার আর অধর্ম বহুবার আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে। কিন্তু ছিন্ন মেঘ কিছুক্ষণ সূর্যকে আচ্ছাদিত করলেও তা কখনোই সূর্যের অস্তিত্বকে বিলীন করতে পারে না। তাই অধর্ম যতই প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, তা কখনোই ধর্মকে গ্রাস করতে পারবে না। পুনরায় ধর্ম দীপ্তিমান হয়ে সাময়িক অন্ধকারকে বিদুরিত করবে। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৪/৭-৮) বলছেন,
‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানধর্মস্য তদাত্মনং সৃজাম্যহম্ ॥
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥’
‘হে ভারত, যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই। সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।’
বৈদিক শাস্ত্রে আমরা দেখতে পাই, যখনই অধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছে, তখনই ভগবান স্বয়ং অবতার গ্রহণ করে অথবা তার ভক্তদের দ্বারা সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করেছেন। সনাতন ধর্মে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। এখানে সর্বদা শান্তির জয়গান গাওয়া হয়েছে। মহাভারতে কুরু-পা-ব যুদ্ধের প্রাক্কালে ভগবান স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রের কাছে শান্তির প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি যুদ্ধ চাননি, শান্তি চেয়েছিলেন। যখন শান্তির সকল মার্গ বন্ধ হয়ে গেল, তখনই কেবল যুদ্ধ আবশ্যক হলো। তাই যতক্ষণ শান্তির পথ খোলা আছে, ততক্ষণ যুদ্ধ আর সহিংসতার কোনো স্থান নেই।
ভগবদ্গীতায় (৭/১৫) আরও বলা হয়েছেÑ
‘ন মাং দুষ্কৃত ন মূঢ়া প্রপদ্যন্তে নরাধমা।
মায়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ ॥’
‘সন্ত্রাসী, মূঢ়, নারাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা অসুরিক ভাবসম্পন্ন, সেই সমস্ত দুষ্কৃতকারীরা কখনও আমরা শরণাগত হয় না।’
যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন ব্যক্তি তারা সর্বদা বিশৃঙ্খল সমাজের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। যারা প্রকৃতই ভগবানের শরণাগত তারা কখনও হিংসাত্মক কার্যে লিপ্ত হতে পারে না।
স্থান, কাল, পাত্র অনুসারে একেক জনগোষ্ঠী একেক রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান তথা ধর্ম পালন করলেও সকলের সৃষ্টিকর্তা একজন; তাকে কেউ ভগবান, কেউ আল্লাহ, কেউ গড ইত্যাদি বলে সম্বোধন করছে। তাই, সকলে যেহেতু এক সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করছে, সেজন্য আরাধনার পদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সকল ধর্মের মূলনীতিগুলো প্রায় একই রকমের। কোনো ধর্মেই সহিংসতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি; কোনো ধর্মেই সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, লুটতরাজকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। সকল ধর্মেই পরমেশ্বর ভগবান বা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে প্রেমময়ী সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। যা প্রেম দিয়ে তৈরি তাতে সহিংসতার স্থান কোথায়? তাই ধর্মের নামে যদি সন্ত্রাসী কর্মকা- করা হয়, তা কখনোই আদর্শ হতে পারে না। যারা সন্ত্রাসী, তারা কোনো সৎধর্মের অনুসারী হতে পারে না। তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের শত্রু।
সনাতন ধর্ম এমনই একটি ধর্ম যেখানে শুধু মানুষ নয় প্রতিটি জীবকে সম্মান করার কথা বলা হয়েছে।
‘বিদ্যা বিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ প-িতাঃ সমদর্শিনঃ ॥’ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৫/১৮)
অর্থাৎ, ‘জ্ঞানবান প-িতেরা বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভি, হস্তি, কুকুর ও চ-াল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।’
বৈদিক শাস্ত্রে আত্মতত্ত্বের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে যে, আমরা এই দেহ নই, চিন্ময় আত্মা। যিনি যথার্থই অধ্যাত্মমার্গে অধিষ্ঠিত, তিনি সকল জীবকে আত্মস্বরূপে দর্শন করেন। জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান। এ সমস্ত শিক্ষা স্বয়ং ভগবান প্রদান করেছেন, যাতে এ বিশ্বচরাচরে তার সৃষ্ট সকল জীবে যথার্থ মৈত্রী স্থাপিত হয়। সনাতন ধর্মে যুগে যুগে যত মহান মহান আচার্যের আবির্ভাব হয়েছে, তারা সকলেই এ একই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজ থেকে ৫৩০ বছর পূর্বে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়ে সনাতন প্রেমধর্মের এক নতুন স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তিনি জাতি ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলকে হিংসা-বিদ্বেষশূন্য প্রেম মৈত্রীর এক অদ্ভুত আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। সেকথা সর্বজনস্বীকৃত। তাই, কালের এই মহাসংকটে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিরসনে ঐক্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বসুধৈব কুটুম্বকম্। আমরা সকলেই একে অপরের পরম আত্মীয়, কারণ আমরা সকলেই এক পরম পিতার সন্তান। আসুন বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামনায় সকলে প্রেম, মৈত্রীর জয়গান গাই। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, ইসকন্ , বাংলাদেশ