আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দুর্বল হয়ে পড়া জঙ্গিরা এখন নারী সংগ্রহে ব্যস্ত
আজাদ হোসেন সুমন ও সুজন কৈরী: আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় দুর্বল হয়ে পড়া জঙ্গিরা এখন নারী সংগ্রহে ব্যস্ত। বোরকার আড়ালে থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পরিকল্পনা নিয়ে নারীদের দলে ভিড়িয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গ্রেফতার হওয়া কমপক্ষে এক ডজন নারী জঙ্গিকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মাস্টারমাইন্ড তামিম ও মেজর জাহিদুলকে হারিয়ে নব্য জেএমবির বর্তমান নীতি নির্ধারকরাও জঙ্গিবাদে নারীদের ব্যবহার করার দিকেই এগোচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা সোর্সের মাধ্যমে জানতে পেরেছে।
সূত্র জানায়, গত ১৫ আগস্ট জেএমবির নতুন ধারার নারী দলের নেত্রী আকলিমা রহমান মনিসহ মোট ৪ জন গ্রেফতার হয়। আকলিমাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু নারী জঙ্গির তথ্য পেয়ে গোয়েন্দারা তাদের গ্রেফতারে মাঠে নামে। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকায় অভিযান চালিয়ে নাহিদ সুলতানা ও মারজিয়া আক্তার সুমি নামে ২ নারী জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। মারজিয়া আক্তার সুমিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে বেশ কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে জেএমবির সাথে সংযুক্ত হয় এদেরই আরেকটি গ্রুপ হচ্ছে মোটিভিশন গ্রুপ। এই গ্রুপ থেকেই আফিফ, কাইফ, জাইশান ও মফিজ নামে আরও অনেকে সুমির সাথে জিহাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন কথা বলত এবং তাকে যুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য যেমন-আহত ছোট বাচ্চাদের ছবি, মেয়েদের ছবি, অসহায় মানুষের ছবি, কিছু হাদিস, যুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও এবং খিলাফত সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পাঠাত এবং জিহাদে যাওয়ার জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করত। এভাবেই ধীরে ধীরে সুমি মাহমুদ ও অন্যদের দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে জিহাদের জন্য ২০ আগস্ট বাড়ি ছেড়ে চলে যায় এবং সংগঠনের সিদ্ধান্তে মাহমুদের সাথে গাজীপুরের সাইবোর্ড এলাকায় বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা দেশত্যাগ করার পরিকল্পনা করেছিল বলে জানায়। নাহিদ সুলতানাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে ফেসবুকের মাধ্যমে জঙ্গি কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরবর্তীতে সে প্রশিক্ষণের জন্য দাওলাতুল ইসলামের অ্যাপস ব্যবহার করতো। সে নারায়ণগঞ্জ সরকারি তুলারাম কলেজ থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। সে নিজে মাস্টার্স পাস করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র আদর্শিক কারণে ও জঙ্গি মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং উক্ত দলে যুক্ত হওয়ায় সংগঠনের সিদ্ধান্তে একজন এইচএসসি পাস, বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনককে কলেজ টঙ্গী এলাকায় গত ২ মে বিয়ে করে। উল্লেখ্য, তাদের বিয়ের সাক্ষী হিসেবে মাদারীপুরে হিন্দু শিক্ষক হত্যা চেষ্টার প্রধান আসামি ফাইজুল্লাহ ফাহিম ২নং সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিল বলে জানা যায়। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, সংগঠন পরিচালনার জন্য অর্থ আসতো বিদেশ থেকে।
২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জ থেকে ৪ নারী জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। এরা হচ্ছেন, জেএমবির সংগঠকদের একজন ফরিদুল ইসলামের মা ফুলেরা খাতুন (৪৫), দুই বোন শাকিলা খাতুন (১৮) ও সালমা খাতুন (১৬) এবং প্রতিবেশী রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রাজিয়া খাতুন (৩৫)। গ্রেফতারের পর এসব নারী জঙ্গি পুলিশকে বলে, আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন। ‘ফিদায়ী হিজরত’ বা ‘আত্মঘাতী’ হামলার মাধ্যমে তাদের ভাষায় কাফির, মুশরিক, মুরতাদ বা ইসলামের শত্রুদের হত্যার জন্য শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিল তারা। তাদের হেফাজত থেকে জব্দ করা কম্পিউটারের তথ্য থেকে জানা যায়, তারা চাইনিজ ও জাপানি কুংফু-কারাতের ছবি দেখে নিজেরা শারীরিক কসরত করত।
পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জঙ্গি কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব গত ১৪ ও ১৫ আগস্ট গাজীপুর ও ঢাকা থেকে চার নারীকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক রয়েছে একজন। দিন দিন দেশে নারী জঙ্গির সংখ্যা বাড়লেও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তবে এর পরিমাণ খুব কম বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কাউন্টার টেরোজিম ইউনিট সূত্র জানায়, আজিমপুরের আস্তানা থেকে তিন নারী জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো নব্য ধারা জেএমবির শীর্ষ নেতা নূরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তী (২৫), নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরী ওরফে আব্দুল করিমের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা (৩৫) এবং আরেক জঙ্গি নেতা জামান ওরফে বাসারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন (২৩)। জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের ঘটনায় লালবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় এই তিন নারী জঙ্গির নাম স্বামীর নামের পাশাপাশি উল্লেখ করা হলেও তাদের স্থায়ী ঠিকানা নেই।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জঙ্গিদের একের পর এক পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যাওয়ায় তারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করছে-আর সেটা হচ্ছে, নাশকতামূলক কর্মকা-ে নারীদের ব্যবহার করা। গোয়েন্দাদের মতে, তারা জঙ্গি নেটওয়ার্কের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ফলে জঙ্গিরা যে ফন্দিই আটুক না কেন- গোয়েন্দাজালে সেটা ধরা পড়ে যাচ্ছে। নারী জঙ্গিদের তথ্যও এখন গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে। গ্রেফতার এড়িয়ে থাকা বাকি নারী জঙ্গিরাও খুব শিগগিরই ধরা পড়ে যাবে বলে গোয়েন্দারা আশা ব্যক্ত করেছেন। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম