
বিশ্বাসের তীর্থযাত্রায় ধর্মপল্লীর কিছু কথা
ফাদার নরেন জে. বৈদ্য
বিপুলসংখ্যক খ্রিস্টভক্তের সমাগমে আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে ২৬ আগস্ট বানিয়ারচরে নবনির্মিত গির্জাঘর কোরিয়া চার্চের উপকারী বন্ধুগণের আর্থিক সহযোগিতায় উদ্বোধন ও আশীর্বাদিত হয়। বানিয়ারচর গ্রামের জীবন প্রবাহে নবনির্মিত পবিত্র গির্জাটি একটি মাইলফলক। নতুন গির্জাটি বহুসংখ্যক বিশ্বাসীভক্তকে আকৃষ্ট করবে, তাদের প্রার্থনার জীবন এবং আরাধ্য সংস্কারে উপস্থিত খ্রিস্ট প্রভুর প্রতি তাদের ভক্তি গভীর করবে।
নব নির্মিত গির্জাঘর উদ্বোধন এক মহাআনন্দের উপলক্ষ, ঈশ্বরের পূজা, প্রশংসা আর ধন্যবাদের ন্যায্য, বিহীত ও সমীচীন এক পুণ্য লগ্ন। অত্র ধর্মপল্লী থেকে ৬ জন পুরোহিত ও ৬ জন সিস্টার হয়েছেন যারা ম-লীর সেবাকাজে রয়েছেন। বিশ্বাসী ভক্তরাই ম-লীর প্রাণ। যারা বানিয়ারচর, কলিগ্রাম, নয়াকান্দি ও ফরিদপুরে খ্রিস্টবিশ্বাসের বীজ বপন ও পরিচর্যা করেছেন সেসব জীবিত-মৃত নিবেদিত প্রাণ পুণ্যাত্মাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। গির্জা নির্মাণে বিভিন্ন ব্যক্তির অবদান, কৃতিত্ব ও আত্মদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি ও সাধুবাদ জানাই। ফাদার কমল খাঁর সহযোগিতায়, দক্ষিণ কোরিয়ার বিশপ ও পুরোহিতগণের আর্থিক অবদানে নবনির্মিত গির্জাটি নির্মিত হয়।
উল্লেখ্য, গত ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বানিয়ারচর ধর্মপল্লী ছিল খুলনা ধর্মপ্রদেশের অধীনে। স্বর্গীয় বিশপ দান্তে বাত্তালিরিয়েন, এসএক্স, স্বগীর্য় বিশপ মাইকেল এডি রোজারিও, সিএসসি, বিশপ বিজয় এনডি ক্রুশ, ওএমআই ও বিশপ জেমস্ রমেন বৈরাগী উক্ত ধর্মপল্লীর আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। চলতি বছর ১০ এপ্রিল থেকে বরিশাল ধর্মপল্লীর অধীনে বিশপ সুবত লরেন্স হাওলাদারের সুযোগ্য নেতৃত্বে বানিয়ার ধর্মপল্লী পরিচালিত হচ্ছে।
কত ভক্তজন বীজ বুনে গেছে আর আমরা আনন্দের সঙ্গে নিয়ে আসছি ফসলের আঁটিঁ।
“কত বিচিত্র ঈশ্বরের সকল কর্মকীর্তি! সেই সব কীর্তি দেখে ভক্তবিশ্বাসী অভিভূত, কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত। যারা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বীজ বুনে যায়, আনন্দের গান গাইতে গাইতে তারা ফসল তুলে আনে” ( গীতসংঙ্গীতা ১২৬: ৪-৫)। খ্রিস্ট প্রেমাগ্নিতে প্রজ্জ্বলিত হয়ে, কালের প্রবাহে সময়ের আবর্তে বানিয়ারচর ধর্মপল্লীতে সালেসিয়ান, জেভেরিয়ান মিশনারীগণ ও স্থানীয় পুরোহিতগণ এবং সিস্টারগণ ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পালকীয় সেবাদান, চিকিৎসা ও শিক্ষামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে ফাদার, সিস্টার ও ব্রাদারদের বহু স্মৃতি, অনেক কথা, বিচিত্র ঘটনা। মঙ্গলসমাচার ঘোষণার বিভিন্ন দিক হলো : সাক্ষ্যদান, ধর্মশিক্ষা, দীক্ষাস্নান, ম-লীভুক্তকরণ, সংস্কৃত্যায়ণ এবং মানব উন্নয়ন।
বানিয়ারচর ধর্মপল্লীর ঐতিহাসিক পটভূমি : শিকড়ের সন্ধ্যানে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ফাদার তাবেজ্জা (পিমে) সর্বপ্রথম গোয়ালন্দ থেকে বানিয়ারচর আসেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কয়েকটি পরিবার ক্যাথলিক ম-লীভুক্ত হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে বানিয়ারচর ধর্মপল্লী গৌরনদী ধর্মপল্লী দ্বারা পরিচালিত হত। ১৯২৮ সালে নারিকেলবাড়ি ধর্মপল্লী এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগর ধর্মপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগর থেকে বিশপ স্কুয়েদিয়েরি সর্বপ্রথম পরিদর্শনে আসেন। তখন কাটেখিস্ট কৃষ্ণনগরের বাবু সেবাস্তিয়ান বিশ্বাস। এ পর্যন্ত খ্রিস্টভক্তদের সংখ্যা ছিল ৯৪ জন। ঐ সময় ফাদার পান্না, ফাদার রিগত্তো ও ফাদার বিয়াংকি পালকীয় কাজ করেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে গির্জার নামকরণ করা হয় পবিত্র পরিত্রাতার গির্জা। এ ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং খুলনা ধর্মপল্লীর অন্তর্ভুক্ত হয়। ফাদার বিয়াংকি (সালেসিয়ান) স্থায়ীভাবে কাজ করতেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে জাভেরিয়ান ফাদারগণ ধর্মপল্লীর পালকীয় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পালক পুরোহিত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফাদার মারিও ভেরনেসি সেন্ট মাইকেল জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ফাদার আন্তন আলবার্টন ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি ডিসপেন্সারি স্থাপন করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল বর্তমান গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ফাদার সমাজের দরিদ্র বেকার মানুষের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি ও সেবাদানের জন্য ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাইসমিল ও সমবায় সমিতি স্থাপন করেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফাদার আন্তন আলবার্টন-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সিস্টার ইমেল্ডা, সিস্টার সুপ্রিয়া, সিস্টার নিবেদিতা এসএমআরএ বানিয়ারচরে কাজ করতে আসেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে নয়াকান্দিতে প্রথম গির্জাঘর ও কাটিখিস্টদের থাকার ঘর নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ফাদার জেমস্ রিগালি আন্তম-লিক সুসম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করতে ‘জনবাক’ নামক মা-লীক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহার : গির্জাঘর নির্মাণের স্বার্থকতা হবে তখনই যখন খ্রিস্টভক্তগণ নিয়মিত এখানে উপাসনায় যোগদান করবেন এবং এই গৃহের মর্যাদা রক্ষা করবেন। সেই সাথে আমরা যেন মনে রাখি যে, ঈশ্বরকে উপাসনা করার প্রকৃত স্থান আমাদের হৃদয় মন্দির। হৃদয় মন্দিরে উপাসনা সুন্দর হলে এই বাহ্যিক মন্দিরের উপাসনাও ঈশ্বরের গ্রহণযোগ্য হবে। হৃদয় মন্দির ঈশ্বরের জন্য উপযুক্তভাবে সাজানো এবং সেখানে পবিত্রভাবে উপাসনা করার কাজটি আমাদের সারা জীবনের সাধনা। প্রভুর গৃহ নির্মাণের সাথে সাথে আমরাও যেন পবিত্র আত্মার মন্দির হয়ে উঠতে পারি। আমার বিশ্বাস প্রতিটি বিশ্বাসীভক্ত সামাজিক জীবনে মিলনে আনন্দ পাওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করবে ও পরস্পরের অন্তরে যাত্রা করবে। ধ্যানে জ্ঞানে ও আচরণে ঐশবাণী হয়ে উঠুক নিত্যদিনের সহচর। নব নির্মিত গির্জাঘরকে কেন্দ্র করে স্থানীয় খ্রিস্টীয় সমাজে ঐশবিশ্বাসের ও মিলনের গভীরতার আশীর্বাদ নেমে আসুক। দয়ার মাতা মা মারীয়া সকল বিশ্বাসীভক্তদের তাঁর স্নেহাশ্রয়ে নিরন্তর রক্ষা করুন।
