মহজিদ পাড়ার বাতিঘর
আবদুস সাত্তার খান
কিছুদিন আগে ‘দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও আমাদেরসময় ডটকম’-এ গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন নিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটি পড়ে এক ভদ্রলোকের আমাকে ফোন করেন। বলেন, ‘আমি আবল হাসান। নওগাঁয় আমার বাড়ি। আমাদের একটি পাঠাগার আছে। ভাই, আসেন না একদিন, আমাদের পাঠাগারটি দেখে যাবেন’
নওগাঁ! কয়েকদিন আগে কথাসাহ্যিতিক জাকির তালুকদারের ‘পিতৃগণ’ পড়ে নওগাঁর প্রেমে পড়ে গেছি। সত্যি বলতে কী, দিব্যেক রুদক আর ভীমের প্রেমে পড়ে গেছি। এসব ভূমিপুত্রদের স্মৃতি বিজড়িত বরেন্দ্রই আজকের নওগাঁ। ফলে আর দেরি না করে রাজি হয়ে গেলাম। মহজিদ পাড়ার দিকে মেশিনচালিত আমাদের ভ্যান এগিয়ে যাচ্ছে। সাপাহারের একটি গ্রাম মহজিদ পাড়া। বরেন্দ্রের এই অসমতল লালময় সবুজে ঘেরা ভূমি আমাকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করছে। পাশে বসা আকাশ ভাই বলে যাচ্ছেন, দিব্যেক আর ভীমের কথা। বলে যাচ্ছেন, তাদের অতীত ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথা। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে ভূমিপুত্র কৈবর্ত নেতা দিব্যেকের নেতৃত্বে মহিপালকে পরাজিত করে কীভাবে এখানকার ভূমিপুত্ররা স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। টানা ৩৭ বছর স্বাধীন রেখেছিল এই বরেন্দ্রভূমি। সেইসব গল্প শুনে আমার বুকটাও ভরে যায় গর্বে।
ছবির মতো একেকটা গ্রাম। সারি সারি তালগাছ, আমের বাগান আর তারই বুকচিরে সাপের মতো একেবেকে চলে গেছে একেকটি রাস্তা। রাস্তার দুপাশে মাটির ঘর। এককথায় আমি যেন হাজার বছর আগের কোনো গ্রামের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। কখন যে মহজিদ পাড়া এসে পৌঁছেছি বুঝতেই পারিনি। আবুল হাসান ভাই বরণ করে নিলেন আমাদের। মাটির দেয়ালের চারচালা টিনের ঘর। বারান্দার মেঝেতে বাচ্চারা বই পড়ছে। ভিতরে চলছে নানা প্রতিযোগিতা। কিছুক্ষণ পরেই পুরস্কার দেওয়া হবে। পুরো পাঠাগার প্রাঙ্গনজুড়েই একটা উৎসব উৎসব আমেজ।
এরই মাঝে নওগাঁ থেকে রহমান ভাইয়ের নেতৃত্বে জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদের ৭-৮ জনের একটি দল এসে উপস্থিত হলেন। আবুল হাসান ভাই আমাদের নিয়ে বসলেন পাঠাগারের বারান্দার মেঝেতে। বললেন, তার স্বপ্নের জন্মকথা। এই ঘরটি ছিল তাদের ভাঙা আসবাবপত্র রাখার জায়গা। বাপ-চাচা তিনজনই গত হয়েছেন। তিনিও চাকরি সূত্রে ঢাকায় থাকে। ছেলেমেয়েরা সবাই যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বাড়িটি অব্যবহৃত পড়ে থাকে। ভাবলেন, বাপ-চাচার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটা পাঠাগার দিলে কেমন হয়। ছেলেমেয়ে, ভাই-ভাতিজা সকলেই রাজি। শুরু হয়ে গেল পাঠাগার স্থাপনের কাজ। নাম দিলেন, ‘জামাল-কামাল- জালাল স্মৃতি পাঠাগার,’ যা এখন এই মহজিদ পাড়ার একমাত্র বাতিঘর।
আড্ডার মাঝে মাঝে বাড়ির ভিতর থেকে আসছে নানান স্বাদের পিঠা। আর পাঠাগারের ভিতরে চলছে কবিতা, ছবি আঁকা, গল্প লেখার প্রতিযোগিতা। দায়িত্বে আছে ছেলে ইফতি, মেয়ে মৌ। মৌ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে একটি কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছে। ভাবতেই ভালো লাগছে, এভাবেই যদি সবাই নিজ নিজ গ্রামটিকে নিয়ে ভাবত, পাড়াটি নিয়ে চিন্তা করত, নিজের গ্রামে পাঠাগার স্থাপন করত, আমাদের গ্রামগুলো গড়ে উঠত সত্যিকার সুন্দরের প্রতিচ্ছিবি।
একসময় আমাদেরও ডাক পড়ল ভিতরে। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে হবে। মৌ একে একে ঘোষণা করছে বিজয়ীদের নাম। আমরা একেকজন বিজয়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছি কলম, রং পেন্সিল, বই। আর অভিভূত হয়ে দেখছি আগামীদিনের দিব্যেকদেরÑ যাদের হাতেই আলোর মশাল এই সোনার বাংলার।
লেখক: সংগঠক, গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন
সম্পাদনা: আশিক রহমান