নীরবতাই যখন সরবতা : ওমরান ও অ্যালেক্সের গল্প
মাহফুজ জুয়েল
প্রিয় প্রেসিডেন্ট ওবামা,
সিরিয়ায় অ্যাম্বুলেন্সে বসা সেই ছেলেটির কথা কি মনে আছে? আপনি কি তাকে আনতে যাবেন, নিয়ে আসবেন আমার বাড়িতে? আমরা আপনাদের জন্য পতাকা, ফুল ও বেলুন নিয়ে অপেক্ষা করব। আমরা তাকে একটি পরিবার দেব, সে হবে আমাদের ভাই। আমার ছোট বোন ক্যাথেরিন, তার জন্য প্রজাপতি আর জোনাকি সংগ্রহ করে নিয়ে আসবে। স্কুলে ওমর নামে আমার এক সিরিয় বন্ধু আছে। আমি তাকে ওমরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আমরা একসঙ্গে খেলব।
আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত দেব। সে আমাদের অন্য একটি ভাষা শেখাবে। আমরাও তাকে ইংরেজি শেখাব। ঠিক আমার জাপানের বন্ধু অটোর মতো। প্লিজ, তাকে বলবেন, অ্যালেক্স তার ভাই হবে, যে ঠিক তার মতোই খুব দয়ালু। সে যেহেতু তার সঙ্গে কোনো খেলনা আনতে পারবে না, কারণ তার কোনো খেলনা নেই। ক্যাথেরিন তার বড় সাদা বানি পুতুল তার সঙ্গে ভাগ করে নিবে এবং আমি আমার বাইক তার সঙ্গে ভাগ করে নেব। আমি তাকে বাইক চালানো শিখিয়ে দেব। আমি তাকে অঙ্কের যোগ-বিয়োগ করা শেখাব এবং সে ক্যাথরিনের সবুজ রঙের পেঙ্গুইন লিপ গ্লসটার ঘ্রাণ নিতে পারবে, যেটা সে কাউকে ছুঁতে দেয় না।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার জন্য অধীর অপেক্ষায়!
অ্যালেক্স, ৬ বছর বয়সী
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এই চিঠি লিখেছে ছয় বছরের মার্কিন শিশু অ্যালেক্স। চিঠির ‘অ্যাম্বুলেন্সে বসা সেই ছেলেটি’ হলো সিরিয়ান যুদ্ধের ‘বুদ্ধশিশু’ পাঁচ বছর বয়সী ওমরান দাকনিশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে গত ১৭ আগস্টে বিমান হামলায় বিধ্বস্ত একটি ভবন থেকে ওমরানকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় আরও উদ্ধার করা হয় ওমরানের বাবা-মাসহ একবছর ও ১০ বছর বয়সী আরও দুই ভাইকে। ওদেরকে উদ্ধারের কিছুক্ষণ পরেই হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িটি ধসে পড়ে। আর মাথায় আঘাত পাওয়া ওমরানকে রক্ত ও ধুলো মাখামাখি অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। তখন তার ভিডিও দৃশ্য ধারণ করেন সরকারবিরোধী গ্রুপ আলেপ্পো মিডিয়া সেন্টারের কর্মীরা। তারা ভিডিও থেকে নেওয়া একটি ছবিও সে সময় ইন্টারনেটে প্রকাশ করেন। আর সেই ছবিটিই ‘ভাইরাল’ হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়ায় মেতে ওঠে ইন্টারনেট বিশ্ব। এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখে মার্কিন ওই শিশু। কিন্তু সিরিয়ায় যখন প্রায় প্রতিদিনই এ রকম হাজার হাজার শিশুসহ সব বয়সী নারী-পুরুষ নির্বিচারে মরছে, তখন ওই এক আহত ওমরান কেন ভোতা-হৃদয় আর পাথরমনা পৃথিবীবাসীর নজর কাড়ল? সেটা অবশ্য যতটা না বলার, তারচেয়ে বেশি দেখার বিষয়।
বিধ্বস্ত বাড়ি থেকে উদ্ধারের পর মাথায় আঘাত পাওয়া রক্তধুলোমাখা ওমরানকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়, তখন তার চোখে-মুখে ছিল নিস্পৃহ নির্লিপ্ত উদাস দৃষ্টি। যন্ত্রণার কোনো অভিব্যক্তি ছিল না তার। ছিল না শিশুসুলভ কোনো কান্নাকাটি। এমনকি চোখে এক ফোঁটা অশ্রুও ছিল না।
ওমরানের ওই নীরবতাই তখন সরবতা হয়ে গেল। কান্নাকাটি না করেই সে সারাবিশ্বকে নাড়া দিল। গ্রহবাসী দেখতে পেল, সিরিয়ায় পাঁচ বছরের অব্যাহত যুদ্ধ ও বিশ্বমানবতার সম্মিলিত ব্যর্থতার এক মহাকাব্যিক আলোকচিত্র। দেখতে পেল, সভ্যতার নামে কী অসভ্যতাই না করে চলেছে বিশ্ব মাতব্বরেরা। উদাস ওমরান কোনো কান্নাকাটি, চিৎকার ছাড়াই পৃথিবীর সব দেশ, সব জাতি, সব মানুষকে না বলা অনেক কথা বলে দিল এবং একইসঙ্গে গোটা সভ্যতাকে ন্যাংটো ও ফতুর করে দিল। ওর রক্তধুলোমাখা নির্লিপ্ত চোখের সামনে আমরা কম বেশি সবাই এখন ফতুর। সবচেয়ে বেশি ফতুর জাতিসংঘ।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান