প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি করতে চায় ভারত
মোহসীন আব্বাস: ভারতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম রপ্তানি। প্রতিবছর দুশ’ কোটি ডলার এই খাত থেকে আয় করতে চায় দেশটি। বহুদিন থেকেই ভারত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানিকারক দেশ। তবে এখন আর কেবল আমদানিতে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না। এখনই আমদানি বন্ধ করা না গেলেও রপ্তানি শুরু করতে চায় দ্রুত। প্রাথমিকভাবে কিছু পণ্য রপ্তানি করেছে। গত বছর এই রপ্তানির অর্থমূল্য ছিলো ৩৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই প্রক্রিয়াকে প্রতিবছর ২০০ কোটি ডলারে নিয়ে যেতে চান। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের কূটনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। দেশটিকে সরবরাহ আদেশ পেতে হবে নিজস্ব প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করার জন্য। এ জন্য দেশটিতে প্রতিরক্ষা রপ্তানি কৌশল-এসডিএস নামের একটি নীতি গ্রহণ করেছে।। এর দেখভাল করছে ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স প্রোডাকশন-ডিডিপি। আর বিভাগটি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বহির্বিশ্বে ভারতের প্রভাব বাড়াতে এ উদ্যোগ বিশেষ ভূমিকা রখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রাথমিকভাবে ভারত চাচ্ছে নিজেদের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র ও নৌ-প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি করতে। এর পর উদ্যোগ নেবে ট্যাকটিক্যাল সিস্টেম রপ্তানিতে। আর এর জন্য তাকে অংশীদার সন্ধান করতে হবে। সার্বিকভাবে ভারত বিশেষ কিছু অংশীদারের প্রতি মনোনিবেশ করতে চাচ্ছে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গত জুন মাসে ভিয়েতনাম সফর করেন। তখন তার প্রতিদলে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন ভারতের অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। ধারণা করা হয় এই সফরের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো সামরিক উৎপাদন সম্পর্ক জোরদার করা। ভিয়েতনামের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বাইরে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ভিয়েতনামের সশস্ত্রবাহিনীকে আধুনিকায়নে ভারতের সহায়তা কেবল দুদেশের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করবে না, এই উদ্যোগ কৌশলগত রপ্তানির দুয়ারও খুলে দেবে।
বাস্তবতা হলো, ভারত কেবল ভিয়েতনামে রুশ নির্মিত স্বল্প বা মাঝারি পল্লার ক্ষেপণাস্ত্র স্থানান্তরের কথা চিন্তা করছে না। হ্যানয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছে তাদের বরুণাস্ত্র বিক্রির বিষয়েও। বরুণাস্ত্র হলো ৫৩৩ মিলিমিটার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টর্পেডো, যা সম্প্রতি ভারতের নৌবানিনীতে সংযোজন করা হয়েছে। এটা এখন ভারতে তৈরি জাহাজ থেকেই নিক্ষেপ করা যায়। বরুণাস্ত্র ভারতের সাবমেরিন বহরের সামরিক যান থেকেও ব্যবহার করা যায়। এমনকি রাশিয়া নির্মিত কিলো ক্যাটাগরির বোট থেকেও বরুণাস্ত্র ব্যবহার করা যায়। আর কিলো বোট দিয়েই ভারত ভিয়েতনামী নৌবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
ভিয়েতনামের সঙ্গে ভারতের সামরিক প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা চুক্তি অনুয়ায়ী ভারত ভিয়েতনামের রুশ নির্মিত সরঞ্জাম সম্ভারকে আপ-গ্রেড করবে এবং এগুলোর কারিগরি দিক দেখভাল করবে। কেননা দু’দেশই রুশ সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে। এ কথা বিবেচনা করে ভারত ভিয়েতনামে তাদের অংশীদার প্রতিষ্ঠানের সন্ধান করছে। কেননা ভারতের সরঞ্জামের বাইরে অন্যকোনো প্রযুক্তি সংগ্রহ করা ভিয়েতনামের জন্য খরুচের ব্যাপার।
ইতোমধ্যেই ভারত ভিয়েতনামের দুটো সোভিয়েত কালের ফ্রিগেটকে আপ-গ্রেড করছে। এগুলোতে বসানো হচ্ছে নতুন সোনার (শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের প্রযুক্তি), টর্পেডো নিক্ষেপণ ব্যবস্থা ও নতুন সাবমেরিন বিরোধী রকেট নিক্ষেপণ ব্যবস্থা। কাকতালীয়ভাবে এই ফ্রিগেটগুলোকে ৫৩৩ মিলিমিটার টর্পেডো লাঞ্চার দ্বারা সজ্জিত করা সম্ভব। আর এতে করে এই সম্ভাবনা জোরালো হয় যে, এই আপ-গ্রেডিং চুক্তির মধ্যদিয়েই হয়তো প্রথম বরুণাস্ত্র বিক্রি শুরু হবে। সোভিয়েত পর্বের অন্য সমর সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে টি-৫৪/৫৫ ব্যাটেল ট্যাংক, বিএমপি জাতের ইনফেন্টি ফাইটিং ভেহিক্যাল। ভিয়েতনামী সেনাবাহিনীর এসব সরঞ্জামেরও আধুনিকায়ন জরুরি। এগুলোতে বসানো হবে নতুন থার্মাল সাইট( তাপ উৎস অনুসন্ধান যন্ত্র) ও গোলাবর্ষণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এছাড়া ভারতের সফটওয়্যার চালিত বেতারযন্ত্রও হয়তো ভিয়েতনাম কিনবে তাদের সাঁজোয়া ও পদাতিক বাহিনীকে সজ্জিত করার লক্ষ্যে।
রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোতে নির্মিত সরঞ্জামকে দেশীয় প্রযুক্তিতে আধুনিকায়নের অভিজ্ঞতা রয়েছে ভারতের। তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা যন্ত্র দিয়ে এসব সরঞ্জামকে উন্নততর করার বিষয়ে। এই অভিজ্ঞতা ভারতকে সেন্সর ও নৌ-চলাচল যন্ত্রপাতির সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে সহায়তা করেছে। এই অভিজ্ঞতাই দেশটিকে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানিতে উৎসাহ যুগিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারত গতবছর এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমানের জন্য মালয়েশিয়াকে সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। মালয়েশিয়ার বিমানগুলো ভারতের উদ্ভাবিত যুদ্ধবিমানের অনুরূপ। এর পর দুদেশ তথ্য, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমঝোতায় উপনীত হয়। আর যেহেতেু ভারত ভিয়েতনামের পাইলটদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, ধারণা করা হচ্ছে ভিয়েতনামেও এমন ধরনের সরঞ্জাম রপ্তানি করবে ভারত।
এর আগে ভারত আফগানিস্তানে হালকা হেলিকপ্টার রপ্তানি করেছে। একই ধরনের হেলিকপ্টার সরবরাহ করেছে নেপাল ও নামিবিয়াতে। মিয়ানমারে রপ্তানি করেছে এইচএমএস এক্স-২ সোনার সিস্টেম। ভিয়েতনামেও এগুলো ভবিষ্যতে সরবরাহ করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ন্যাটো সদস্যদেশ তুরস্কে সরবরাহ করেছে প্রতিরক্ষামূলক সাঁজোয়া যান। আর আরও অনেক বড় দেশে সরবরাহ করেছে খুচরা যন্ত্রাংশ, মেকানিক্যাল যন্ত্রাদি ও ইলেক্ট্রোনিক যন্ত্রাদি। ভারতের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরবরাহ হলো মরিশাসে ১৩০০ টন ক্ষমতার উপকূলীয় টহল জাহাজ রপ্তানি। এটা ভারতের নিজস্ব উৎপাদনের প্রথম রপ্তানি করা যুদ্ধজাহাজ। ভারত শ্রীলঙ্কার জন্য দুটো টহল জাহাজ নির্মাণ করছে। আর মরিশাসের জন্য নির্মাণ করছে আরও দুটো দ্রুত গতির টহলবোট ও আক্রমণ করতে সক্ষম ১১টি দ্রুতগতির জাহাজ। এর আগে ভারত শ্রীলঙ্কা ও কয়েকটি ভারত মহাসাগর অঞ্চলের দেশে কিছু বোট সরবরাহ করেছে। এখন এসব দেশে টহল জাহাজ, ইন্টারসেপ্টর ক্রাফস, করভেটস ও ফ্রিগেট বিক্রির পরিকল্পনা করছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো বন্দরে টহল দেয়ার জন্য ২০ মিটার বোট, জলসীমায় টহল দেয়ার জন্য ৫০ থেকে ৬০ মিটারের বোট সামরিক কাজের জন্য ৮০ থেকে ১১০ মিটারের বোট নিতে চাইছে ভারত থেকে।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ মুজাম্বিক অবশ্যই ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে চাইবে। তারা তাদের নৌ-শক্তিকে সজ্জিত করতে চাইবে ভারতের সহায়তায়, কেননা ভারত এখন এগুলো সরবরাহে সক্ষম। ইতোমধ্যেই ফিলিপাইনের জন্য দুটো ফ্রিগেট নির্মাণে ভারত সবচেয়ে কম দামের দরপত্র দিয়েছে। ভারতের সরকারি শিপইয়ার্ডের বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সামরিক সরঞ্জাম উন্নয়নের অনুমতি পেয়েছে। এতে করে প্রতিযোগিতা ও মূল্যসাশ্রয়ী হয়েছে ভারতের সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণ খাত।
এদিকে মিসাইল সরঞ্জামও রপ্তানি করবে ভারত। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ‘আকাশ’ রপ্তানি করতে চায় ভারত। আর এ সরঞ্জামের সম্ভাব্য ক্রেতা হতে পারে ভিয়েতনামের বাইরে কিছু আসিয়ানভুক্ত দেশ। এ তালিকায় থাকবে আফ্রিকার কিছু দেশও। কিছু দেশ ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ‘প্রগতি’ কিনতে চায়।
ভারতের সামরিক সরঞ্জাম নিতে চায় এমন দেশের তালিকায় আছে ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজিরিয়া, গ্রিস, থাইল্যান্ড, মিসর, সিঙ্গাপুর, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল ও বুলগেরিয়া। তারপরও সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি খাতে লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সবচেয়ে বেশি যা দরকার হবে, তা হলো কূটনৈতিক সক্ষমতা। দ্য ডিপ্লোম্যাট অবলম্বনে