‘গরু’ ও ‘যুদ্ধ’বিষয়ক জটিলতা
কাকন রেজা : সম্প্রতি ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের উরি সেনা ছাউনিতে আঠারো ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন। আর পরম্পরার পুরনো ধাঁচে এ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার পারদও চড়া। আর বাড়তি উত্তেজনায় দুই পরাশক্তি যখন হুংকার ছাড়ে সঙ্গত কারণেই তখন সে শব্দ গুঞ্জরিত হয় মিডিয়া থেকে প্রতিবেশীদের চায়ের দোকান পর্যন্ত।
তবে এমন ঘটনা এই উপমহাদেশের মানুষ যে আর প্রত্যক্ষ করেনি তা নয়। এমন হুংকার পাল্টা হুংকারও নতুন কিছু নয়। আর এসবকে কেন্দ্র করে সীমান্তে ছোটখাটো গোলাগুলিও অতি চেনা ঘটনা। ‘কারগিল’ এর মতো সীমান্ত যুদ্ধও স্মৃতির বাইরে নয়। তবে একথা সত্যি সাম্প্রতিক সময়ে এটি ভারতের জন্য একটি বড় ঝাপটা। এ ঘটনায় এর মধ্যেই অনেকে অনেক কিছু খুঁজতে এবং দেখতে শুরু করেছেন। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে। চলছে যুদ্ধের সম্ভাবনা এবং পরিণতির সম্ভাব্য চিত্র আঁকার প্রতিযোগিতা। চলছে শক্তি তর্কবাগীশদের বিতর্কও।
দূরদর্শী এবং স্বাপ্নিক এ দুটো শব্দের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন পার্থক্য রয়েছে সংবাদ ও সাহিত্যের মধ্যে। এ শব্দ দুটিকে অনেকেই অনেক সময় গুলিয়ে ফেলেন। ‘রিয়েলিটি’ আর ‘ফ্যান্টাসি’ গুলিয়ে ফেলে ‘যাদু বাস্তবতা’র লাইনে চলে আলোচনার ট্রেন। আমি আপাত যুদ্ধালোচনার সেই ট্রেনে আরোহী হতে চাইছি না। আমার আলোচনার বিষয়বস্তু নিতান্ত নিরীহ একটি প্রাণী ‘গরু’।
এই উপমহাদেশে দুটি দেশ ভারত ও বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ‘গরু’। অবশ্য বর্তমানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার তালে আলোচনার ‘টিআরপি’তে কিছুটা পিছিয়ে এই নিরীহ প্রাণীটি।
তবে ভারতে বিজেপি সরকার অধিষ্ঠিত হবার পর থেকেই মূলত ‘গরু’ সংবাদ মাধ্যমে বড় একটি জায়গা করে নিয়েছে। অতি সাম্প্রতিককালে গরুর গোশত, দুধ এমনকি মূত্র পর্যন্তও সূত্র হয়ে সংবাদ মাধ্যমের একটি অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারাবাহিকতার সূত্রে ‘গরু বিষয়ক জটিলতা’য় এই ‘অকালে’ আমরাও আক্রান্ত।
ভারতে অনেক জায়গায় গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবির্ভূত হয়েছে ‘গোরক্ষক’ নামে একটি ‘মাসলম্যান’ সম্প্রদায়। এদের হাতে গরুর গোশত খাওয়ার বা সংরক্ষণের অভিযোগে মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত এবং লাঞ্ছিত হয়েছেন অনেক মানুষ। বাদ যাননি মহিলারাও। গরুর গোশত খাবার কারণে গণধর্ষণের মতো পাশবতার শিকার হতে হয়েছে মহিলাদের। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সেসব খবর প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়েছে।
গরু বিষয়ক এই উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁচেছে যে, গরুকে ‘জাতীয় মাতা’ ঘোষণার দাবিতে অতি সম্প্রতি গুজরাটের রাজকোটে কয়েকজন আত্মাহুতি দেওয়ার চেষ্টাও করেছেন। গরু রক্ষায় মিছিল সমাবেশ করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।
আর এই উন্মাদনাকে এগিয়ে দিতে পিছিয়ে নেই সেখানের কিছু কথিত বিজ্ঞানীও। গুজরাটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক দাবি করেছেন গো মূত্রে সোনা রয়েছে। রয়েছে নানা অসুখ সারাবার ধন্বন্তরি উপাদানও। জুনাগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষকরা তাদের সখের গবেষণায় জানিয়েছেন, এক লিটার গো মূত্র থেকে নানা প্রক্রিয়ার পর ত্রিশ টাকার সোনা বের করা সম্ভব হলে হতেও পারে।
ভারতে এখন রীতিমতো ‘কোমল’ ‘কঠোর’ পানিয়ের মতোন বোতলজাত করে গো মূত্র বিক্রি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বোতলজাত গো মূত্রের বিক্রিও নাকি ভালো। ভালো হলেই ভালো। এ উছিলায় অন্তত কিছু মানুষ তো করে খেতে পারবে।
কারও ইচ্ছে হলে সে গো মূত্র পান করুক এবং সুস্বাস্থ্য লাভ করুক এতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কারও ধর্ম যদি গরুকে ‘মাতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তাতেও কারও কোনো আপত্তি অগ্রহণযোগ্য। যার যার ধর্ম তার তার। ধর্ম কেন, কারও কোনো বিশ্বাসেই অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না যতক্ষণ না তা কোনো মানব বা মানবগোষ্ঠীর ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।
তবে প্রশ্নটা জাগে তখনই যখন ‘গরু’ নামক প্রাণী রক্ষার নামে পুরাণের ভাষায় ‘অমৃতের সন্তান’, কোরআনের ভাষায় ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ এর উপর নৃশংসতা চালানো হয়। তাদের হত্যা করা হয়, আহত করা হয়, মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ‘আমরা সত্যিই কি সভ্য হয়েছি’?
মানুষ আগুন আবিষ্কারের পরই সে আলোতে সভ্যতার রাস্তায় চলা শুরু করে। যখন কাপড় আবিষ্কারের মাধ্যমে লজ্জা নিবারণ করতে শেখে তখন সভ্যতায় রাস্তায় শুরু হয় তাদের সামাজিক পথ চলা। আর এর ফলেই তারা প্রাণীকূলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। অনেকে অবশ্য বলেন, মানুষও তো প্রাণী। সে অনুযায়ী প্রাণীদের দুটি ভাগ হয়। বিবেক, বিবেচনা, বোধ-বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্বে মানুষ পায় আলাদা মর্যাদা। আর সমস্ত প্রাণীকূল বিবেক ও বিবেচনার অভাবে হয় আলাদা।
‘মানবতা’ শব্দটি সৃষ্টি হয় মানুষ থেকে। পশু থেকে আসে ‘পাশবতা’। তাই মানুষ যখন নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে হত্যা, ধর্ষণের মতো কোনো অমানবিক কাজে জড়িত হয় তখন সেই কাজের আগে যুক্ত হয় পশু থেকে সৃষ্ট ‘পাশবিক’ বিশেষণটি।
যারা পশু রক্ষায় মানুষ হত্যা করেন, ধর্ষণ করেন, লাঞ্ছিত করেন তারা কি মানবতার বদলে ‘পাশবতা’র চাষ করতে চান! তারা কি পশুরক্ষার নামে মানবিক শব্দটিকে ‘পাশবিক’তায় প্রতিস্থাপন করতে চান!
গরু বিষয়ক উন্মত্ততার স্রোত আমাদের উপরও আছড়ে পড়েছে পদ্মা দিয়ে আসা বানের পানির মতো। বানের পানির ভাঙনে যেমন অনেক কিছুই বিলীন হয়ে যায়, তেমনি গরু বিষয়ক উন্মত্ততার স্রোত আমাদের এখানেও সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ধর্মীয় আচার-আচরণ সবই ভাসিয়ে বিলীন করতে চাইছে। আর এই স্রোতের ধারক-বাহক আমাদের দেশেরই কিছু মানুষ। ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ করার মতো কিছু অতি (!) বুদ্ধিমান মানুষ। (চলবে)
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান