দিনটি অচিরেই সমস্ত বাঙালির উদ্যাপনের দিন হবে
ফরিদুন্নাহার লাইলী
কে জানত গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া খোকা নামের ছেলেটি একদিন বাঙালির মুক্তির দিশা হবেন? ভাবেনি কেউ। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে তা জানতে পেরেছে সবাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ঘর আলো করে ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্ম নিয়েছে তাদের প্রথম সন্তান হাসিনা। ভালো নাম শেখ হাসিনা। বাবা মা আদর করে ডাকতেন হাসু। কে জানত এই হাসুই হবেন একদিন তার বাবার যোগ্য উত্তরসূরি? বাবার দেখানো পথে দীপ্ত পায়ে এগিয়ে দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এই দেশ এবং মানুষকে নিয়ে যে স্বপ্ন তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন, সে স্বপ্নের পথে তিনি হেঁটে চলেছেন দুর্বার গতিতে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সাল অবধি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল এমনই অন্ধকারাচ্ছন্ন, যেখানে দমনপীড়ন-শোষণ নির্যাতনে মানুষ ছিল অসহায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া তার দুইকন্যার দেশে আসা ছিল অনিরাপদ। তারপর ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং তার প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের সেই সংবর্ধনা আমরা নিশ্চয়ই বিস্মৃত হতে পারি না। পিতার শোকের সান্ত¡না তিনি সেদিন এই মানুষের মাঝে দেখেছিলেন এবং মনে মনে স্থির করেছিলেন পিতার অসমাপ্ত কাজ তাকেই সমাপ্ত করতে হবে এবং জীবন দিয়ে হলেও করতে হবে। এ কথা তিনি বারবার উচ্চারণও করেছেন। তারপর ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত এক দীর্ঘ স্বৈরাচার সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছেন শেখ হাসিনা। নিজের দল সংগঠিত করতে হয়েছে, নেতা-কর্মীদের মধ্যে আদর্শ স্থাপন করতে হয়েছে। আজ তিনি দেশ ও জনদরদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পিতার মতোই অসীম সাহসী, দৃঢ়তায় অবিচল, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন একজন আদর্শবাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানুষের কাছে আজ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। দেশের যেকোনো সংকটে তার নেতৃত্ব দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছে তিনিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য। সেখানে দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই।
শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্ব ফুটে উঠেছে তার সরকার পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভুতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান নামক যে দেশের শৃঙ্খল থেকে তার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন করে দিয়েছে, সে দেশের সঙ্গে একটু তুলনা করলে বোঝা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এখন এক সময়ের শাসক পাকিস্তানের জন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। এতদিন বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে খোদ পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও বলা শুরু হয়েছে। প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ, রপ্তানি ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে বাংলাদেশ। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেদেশে একটি অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ উদ্বোধনকালে বলেন, তাদের বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার সবেমাত্র ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামীতে পর্যায়ক্রমে ৭ শতাংশে উন্নীত করতে চাই। এজন্য তিনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অন্যদিকে, ১৯৯০ সালের গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। মাঝে মাঝে রাজনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হলেও চলমান আছে স্থিতিশীলতা। এ কারণে আর্থসামাজিক খাতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বৈশ্বিক মন্দা, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম অংশীদার মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যেও বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বিদায়ী বছরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা উপমহাদেশে ভারত ছাড়া আর কোনো দেশের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বিশ্বের অনেক দেশের পক্ষেই ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের রিজার্ভ সঞ্চায়নের হার ছাড়িয়েছে ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অগ্রগতি এবং প্রবৃদ্ধির এই সাফল্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ইতোমধ্যে তারা বাংলাদেশকে নিম্ন-আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্য-আয়ের দেশের তালিকায় উন্নীত করেছে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন হচ্ছেÑ ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি এ অঞ্চলের সন্ত্রাস দমন এবং জঙ্গিবাদ নির্মূল করার লক্ষ্যও তার অবিচল। সমকালীন বিশ্বে জঙ্গিবাদ দমনে তার তুল্য নেতৃত্ব আর দেখা যায় না। মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর অন্তর্গত রাজনৈতিক প্রেরণা তাকে ক্রমাগত আস্থাশীল নেতৃত্বের অধিকারী করে তুলেছে। সার্বিক দিক বিবেচনায়, আজ বাঙালি শেখ হাসিনাকে ‘শান্তিকন্যা’ হিসেবেই দেখছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এরূপ আপসহীনতা ও আস্থাশীলতার কারণেই বিশ্বের বুকে শান্তিকন্যা শেখ হাসিনা সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তার নেতৃত্ব আজ বিশ্বনেতাদের কৌতূহল এবং আগ্রহের বিষয়েও পরিণত হয়েছে। কেবল তাই নয়, বিশ্বপরিম-ল থেকে সম্মাননাও পাচ্ছেন। বিশ্বের নামিদামি গণমাধ্যমের একাধিক জরিপে ইতোমধ্যে বিশ্বনেতাদের তালিকায় শেখ হাসিনার নাম সামনের সারিতে স্থান করে নিয়েছে। সময়ের সঙ্গে ক্রমাগত স্থান সামনে এগিয়ে আসছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে শেখ হাসিনা তার সততা, আত্মত্যাগ, দূরদর্শীতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেনÑ এটাই হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। আজ শেখ হাসিনার জন্মদিন। আমি বিশ্বাস করি, এ দিনটি অচিরেই সমস্ত বাঙালির কাছে উদ্যাপনের দিন হবে।
লেখক: সাবেক সংসদ সদস্য এবং ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সম্পাদনা: আশিক রহমান