বিএনপির কাছে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী নির্বাচন নাকি সুষ্ঠু নির্বাচন?
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: বিএনপির কাছে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী নির্বাচন নাকি সুষ্ঠু নির্বাচন? তারা তাদের লক্ষ্য ঠিক করেছে কিনা, সেটা করে পরিকল্পনা মাফিক কাজ শুরু করেছে কিনা, কিংবা তারা এখন কি করছে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, বিএনপির মূল লক্ষ্য এখন মধ্যবর্তী নির্বাচন নয়, নির্দলীয় সরকার ও স্বাধীন কমিশনের অধীনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতের পর সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা নির্বাচনের প্রাক প্রস্তুতিও শুরু করেছে।
বিএনপির সূত্র জানায়, কয়েকমাস আগেও বিএনপি আগাম নির্বাচন করার কথা বললেও এখন আর তেমনভাবে বলছে না। কারণ বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা এখনো সুসংগঠিত হয়নি। এ কারণে এ সময়ে সরকার তড়িঘড়ি করে বিএনপির আগাম নির্বাচনের দাবি পূরণ করার নামে যদি নির্বাচন দেয়, তাহলে সে নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে সরকারি দলের ও জোটের চেয়ে বেশি আসন পাওয়া সম্ভব হবে না কিংবা কঠিন হবে এমনটিই মনে করছেন। এ কারণে বিএনপির এখন আগাম নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি তোড়জোর নেই। তাদের তোড়জোর সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করা।
সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আশঙ্কা তাদের দুজনকেসহ বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ যেসব নেতাদের নামে মামলা করা হয়েছে , যারা নির্বাচেন প্রার্থী হতে পারেন কিংবা করা হতে পরে এমন কমপক্ষে দুই শতাধিক নেতাকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। সরকার তাদের বিভিন্ন মামলায় শাস্তি দিয়েই তা করতে চাইছে। এ জন্য বিএনপি ওইসব নেতাদের যাদের সরকার নির্বাচন থেকে মাইনাস করতে না পারে সেজন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচনে অংশ নিবেন। এ জন্য তারা আইনি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রস্তুতিই রাখছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ সরকার জনগণের সরকার নয়। তারা স্বৈরাচারী সরকার। এ কারণে জনমত উপক্ষো করে তাদের অধিকার হরণ করে নিজেরাই ভোটের বাক্স ভরে ও ১৫৪ আসনে বিনা নির্বাচনে জয়ী করিয়ে নিয়েছে প্রার্থীদের। এরপর সরকার গঠন করেছে। এটাকে নির্বাচন বলা যাবে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল নির্বাচনের নামে প্রহসন। এবারও সরকার সেই কাজটি করতে চাইছে। তারা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসতে চাইবে। বিএনপিকে বাদ দিয়ে আমাদের সবাইকে মাইনাস করে তাদের মনের মতো দলগুলো নিয়ে সমঝোতার সরকার গঠন করতে চাইছে।
তিনি অভিযোগ করেন, ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার জন্য সব ধরনের নীল নকশা বাস্তবায়ন করছে। তাদের এসব ষড়যন্ত্র সফল হতে দেওয়া হবে না। আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা মধ্যবর্তী নির্বাচন চাই না। সার্চ কমিটির নামে সরকারের পছন্দের লোকদের বসিয়ে একটি পাতানো নির্বাচন করতে চাইছে আমরা সেটা চাই না। আমাদের দাবি বাংলাদেশের জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। আর সেটা করতে হলে একটি স্বাধীন কমিশন দরকার। কমিশনারদেরও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু সরকার নির্বাচনের নামে প্রহসনের নাটক করার জন্য আবারও সেই পাতানো নির্বাচন করতে চাইছে। সেটা হতে দেওয়া হবে না।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা বলেন, সরকার চাইছে যদি তাদের সব পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সফল করতে পারে তাহলে লোক দেখানোর জন্য আগে ভাগেই একটি নির্বাচন দিবে। আর সেই নির্বাচনে বিএনপিকে নিতে চাইবে না। তারা আমাদের প্রধান দুই নেতাসহ অনেক নেতাকেই মাইনাস করতে চাইছে। তাদের মাইনাস করেই তারা একটি নির্বাচন দিবে। আমাদের নেত্রী ও নেতাকে মাইনাস করতে পারলে এরপর তারা বিএনপির অবশিষ্ট নেতাদের নিয়ে একটি নির্বাচন করবে। সেক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা থাকার পরও পরিকল্পিতভাবেই তারা ভোটের বাক্স ভরে নিয়ে নিজেরা ২০২টির বেশি আসনে জয় লাভ করেছে দেখিয়ে ফের সরকার গঠন করবে। নানা দিক থেকেই আমরা এগুলো শুনছি। আমরা তা হতে দিতে পারি না। সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা দেশের স্বার্থবিরোধী প্রকল্পও এ জন্য বাস্তবায়ন করতে পিছপা হচ্ছে না। কারণ দেশের স্বার্থবিরোধী প্রকল্প নিলেই অন্যদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। আর তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হলেই বিএনপিকে মাইনাস করার জন্য তাদের ফের ক্ষমতায় বসানোর জন্য সমর্থন ও সহযোগিতা দিবে।
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা বলেন, সরকার পছন্দের সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে তাদের পুতুল কমিশন গঠন করতে চাইছে তা মানব না। এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন হতে হবে। আমরা সেই সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা করব।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, সরকার যত ধরনের চেষ্টাই করুক আবার ক্ষমতায় বসার জন্য সেটা করা ঠিক হবে না। কারণ জনগণ তা মেনে নিবে না। সরকার এত উন্নয়ন করছে বলে দাবি করে কিন্তু আসলে কি জনগণের কাছে সরকারের জনপ্রিয়তা আছে? বিএনপির পাশে জনগণ আছে। সেটা সরকার যদি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দেয় তাহলেই প্রমাণ হয়ে যাবে। আমরা এ জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের চেয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছি। তিনি বলেন, জাতিসংঘের অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো যখন ঢাকায় সংলাপ করার জন্য আসেন সব দলের সঙ্গে সংলাপ করেন সেখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল সরকার একটি সংবিধান ও নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করবে। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে একাদশ নির্বাচন দিবে। কিন্তু তারা কথা রাখেনি। তিনমাসের সরকারকে এখনো তারা কন্টিনিউ করছে। ২০১৯ সাল পর্যন্তও এ সরকারকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু এগুলো তারা করলেও দেশের জনগণ স্বস্তিতে নেই। কেবল সরকার একবার জনগণকে মতপ্রকাশের আর স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিক দেখা যাবে চিত্র পাল্টে গেছে। এসব সুযোগ দিতে চাইছে না বলেই এত কিছু করছে।
বিএনপির সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুজনই একমত যে মধ্যবর্তী নির্বাচন এখন জরুরি নয়। এখন একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ নির্বাচন জরুরি। এর কোনো বিকল্প নেই। সেখানে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মতো যাতে সরকার ভোটের বাক্স আগেই ভরে নিতে না পারে সে জন্য কাজ করা। আর তা করার জন্য তারা করণীয়ও ঠিক করেছেন। ধীরে ধীরে এগুচ্ছেন। সবার আগে গুরুত্ব দিচ্ছেন দলকে সংগঠিত করা। দলের ভিত শক্ত করা। নির্বাচনে সম্ভাব্য এমন প্রার্থী দেওয়া যাতে করে তারা নিজেরাই ওই সব আসনে জয়ী হতে পারে।
বিএনপির সূত্র জানায়, বিএনপি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে চাইছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশনের অধীনে নির্বাচন করানোর জন্য চাপ তৈরি করাতে। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকারের নাম যাই হোক না কেন শেখ হাসিনা সরকার প্রধান থাকতে পারবেন না। কারণ তার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এছাড়াও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে কমিশন গঠন করা না হলে নির্বাচন যতই সরকার মুখে দাবি করবেন নিরপেক্ষ হবে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হবে না। এছাড়া প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে দিতে হবে। ইতোমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, নেশা দেশাইসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কাছেও আগামী নির্বাচন বিষয়ে আলোচনাকালে এসব আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন। সংলাপ জরুরি তাও জানিয়েছে। বিএনপি কি চায় সেগুলো তাদের কাছে তুলে ধরে বলেছে, এ দেশের জনগণও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা মনে করি জনমত নিয়ে ও সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই সার্চ কমিটির মাধ্যমে সরকারকে কমিশন করতে হবে। তাদের মনের মতো করলে হবে না। আর সংলাপ হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা যত দ্রুত সম্ভব সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম