শোষণমুক্ত সমাজ ও শেখ হাসিনা
বাহালুল মজনুন চুন্নু
মানবজাতির ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। সেই ইতিহাসে আছে রক্তপাত, আছে আত্মত্যাগের সমুজ্জ্বল মহিমা। সমাজের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত বহু ধরনের শক্তির দ্বন্দ্ব চলে আসছে অনাদিকাল হতে। শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, জাত, রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ এ রকম আরও অনেক বিভাজনের মধ্যে দিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে আসছে অবিরত। সেই সঙ্গে চলে আসছে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সংগ্রাম। ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশো তার ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ (সামাজিক চুক্তি) বইতে বলেছিলেন, মানুষের জš§ হয় মুক্ত হয়ে, কিন্তু জšে§র পরই দেখে তার চারদিকে বাধার শেকল। এই শেকলই হচ্ছে, শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। সেই শোষণ-নিপীড়নের হাত থেকে মানবমুক্তির জন্য, সামাজিক অসাম্য দূর করার জন্য যুগে যুগে দার্শনিকগণ, সমাজতাত্ত্বিকগণ নানা পথ বাতলে দিয়েছেন। সেইন্ট সাইমন, চার্লস ফুঁরিয়ে, ওয়েন প্রমুখ যেখানে সামাজিক অসাম্য, শোষণকে দূর করতে চেয়েছিলেন সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে, সেখানে কার্ল মার্কস, প্রুধুন, বুকিনিন, ব্লাঙ্কুই প্রমুখদের কেউ কেউ নৈরাজ্যবাদী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আবার কেউ কেউ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা করতে চেয়েছেন। তাদের মতাদর্শ অনুসরণ করে দেশে দেশে সংঘটিত হয়েছে নানান বিপ্লব, নানান লড়াই-সংগ্রাম। কার্ল মার্কস, লেনিন, মাওসেতুং, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তপাতের অনিবার্যতাকে বেছে নিয়েছিলেন। তাদের কাছে বিপ্লব ও রক্তপাত যেন একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি হেঁটেছেন রক্তপাতহীন বিপ্লবের পথে।
তার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে।’ এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজ ব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে।
তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করতে চাই’ তখন এই বাংলায় অন্ধকারের গহীন অমানিশায় আটকে পড়া গরিব মেহনতি মানুষেরা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। সপ্তম শতকে গৌড়ের প্রথম সার্বভৌম নরপতি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শতবর্ষব্যাপী অনৈক্য, আত্মকলহ, অনিয়ম, দুর্বলের ওপর সবলের নির্যাতন-নিপীড়নসহ নানা অরাজক পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। সেই অরাজক পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘মাৎসন্যায়’। ঠিক সেই মাৎসন্যায় পরিস্থিতিই বিরাজ করছিল পঁচাত্তরের পরের একুশটি বছর। আমেরিকার খ্যাতিমান নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গানের ‘এনসিয়েন্ট সোসাইটি’ (প্রাচীন সমাজ) বইতে মানুষ বন্যদশা থেকে বর্বরদশায় উত্তীর্ণ হলে যে পরিস্থিতির দৃশ্যপট উল্লেখ করা হয়েছিল, তার থেকেও ভয়ংকর দৃশ্যপট প্রতিটি ক্ষণে মঞ্চস্থ হয়েছিল। চারদিকে শুধু হত্যা, লুটপাট-রাহাজানি, দুর্নীতির মহোৎসব। পুরো দেশকে ঘিরে ধরেছিল দুর্ভেদ্য নিশিথিনী। সেই নিশিথিনী থেকে বাংলার মানুষকে মুক্তি দিতে আলোকবর্তিকা হাতে হাজির হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা।
জšে§র পর থেকেই শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর সৌন্দর্য, কাশবন, সবুজ বৃক্ষরাজির সৌন্দর্য যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন দারিদ্রপীড়িত জনগোষ্ঠীর বিবর্ণ চেহারা, শুনেছেন তাদের নিদারুণ ক্রন্দন। দেখেছেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের অমানবিক শোষণের বিরুদ্ধে পিতার দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ। তাই তো তিনি দেশ ও মানুষকে ভালোবেসে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিরলস সংগ্রামে অবিচল পথ হেঁটে চলেছেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দীর্ঘ পনেরো বছর বাংলার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী পুঁজিপতিতের স্বার্থ রক্ষাকারী বিএনপির দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ছিয়ানব্বই সালে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ধ্বংসস্তুপের কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াই শুরু করেন তিনি। প্রতি পদেই আসতে থাকে দেশি- বিদেশি নানান বাধা, ষড়যন্ত্র। কিন্তু যার দেহে বইছে জাতির পিতার রক্ত, সে তো ভেঙে পড়ার নয়, থেমে যাওয়ার নয়। তিনি প্রবল বিক্রমে সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আবারও দেশ সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমডিজির আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশ অসামান্য সফলতা দেখিয়েছে। দারিদ্রের হার দেশে মাত্র চব্বিশ দশমিক আট শতাংশ। সেটা অচিরেই নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনে তার সরকার বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দারিদ্র বিমোচন, স্বাস্থ্যে ও শিক্ষার উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশনসহ নানামুখি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছেন। ইতোমধ্যে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে উন্নত বিশ্বের দেশের কাতারে যাওয়ার। এ সবই সম্ভব হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও দক্ষ নেতৃত্বগুণে। তাকে তাই বলা হয় ‘উন্নয়নের জননী’। বলা হয় ‘দেশরতœ’।
তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফিরিয়ে আনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারী বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের দোসররা। ষোড়শ শতকে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তার ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই খারাপ।’ এই কথাটি এ যুগে বিএনপি-জামায়াতের ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে সঠিক। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বকে অস্বীকার করে জনমন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নষ্ট করে দেশকে বানাতে চেয়েছিল পাকিস্তানের তাবেদার রাষ্ট্র। তাই এদের অপরাধ ক্ষমাহীন। এদের চক্রান্ত বাস্তবায়ন হতে দেননি বঙ্গবন্ধু কন্যা। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে দেশকে কেবল কলঙ্কমুক্তই করেননি, দেশে ফিরিয়ে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই শোষণমুক্ত এক আদর্শিক সমাজ। আর সেই পথেই সফলভাবে এগিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এখনও তিনি শোষণের বিরুদ্ধে নিরলস লড়াই করে যাচ্ছেন। তিনি শুধু এদেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করতেই ভূমিকা রাখছেন না, তিনি বৈশ্বিক শোষণের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছেন। ছড়িয়ে দিচ্ছেন সর্বত্র শান্তির বাণী। সাম্রাজ্যবাদীদের ছড়ি ঘোরানো বন্ধ করতে তিনি বদ্ধপরিকর। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাকে নানামুখি চাপ দিলেও তিনি তাদের কাছে মাথানত করেননি। এ কারণেই আজ দেশ শোষণমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে। এক্ষেত্রে সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বলতে হয়, ‘এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ বঙ্গবন্ধু তনয়া যেভাবে এই দেশে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই করছেন তাতে মুগ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসেন ম্যান্ডেলা। তিনি শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তার নেতৃত্বের অসাধারণ গুণ হলো নিপীড়িত, বঞ্চিত, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো। শেখ হাসিনার মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ শেখ হাসিনার সাফল্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘বিপুল জনপ্রিয় নেত্রী হলেও তিনি আসলে সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র্র মানুষের কণ্ঠস্বর।’ সেই কণ্ঠস্বরের কল্যাণেই দেশ আজ দারিদ্র ও ক্ষুধামুক্ত হচ্ছে, শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছে। এ যেন নজরুলের সেই দুই ছত্ররই বহিঃপ্রকাশÑ জয় নিপীড়িত জনগণের জয়/জয় নব উত্থান।
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সম্পাদনা: আশিক রহমান