এ আবেদন না রেখে কি পারা যায়?
রহমান শেলী
বয়স ৮০ হবে। অফিসের গেইটে আসলেন। ঘটনা শুনলেন আমার এক অফিসার। অফিসার এসে জানালেন, স্যার একজন বৃদ্ধ লোক এসেছেন, তার মেয়ের ডিভোর্স বিষয় নিয়ে। বললাম, কী সমস্যা? বললেন, মেয়ের বিয়ের ৮/৯ বছর পর ডিভোর্স হয়েছে। কিন্তু দেনমোহরের টাকা দেয়নি। বললাম, এটা আমার কাজ না। কোর্টে মামলা করতে বলেন।
অফিসার চলে গিয়ে আবার ফেরত আসেন। এসে বললেন, স্যার বৃদ্ধ আপনার সঙ্গে কথা না বলে যাবেন না।
আমার সঙ্গে কেন?
উনি বলেছেন, যে যাই বলুক, আমি কমান্ডারের সঙ্গে কথা না বলে যাব না। নতুন অফিস সেটাপ হচ্ছে। অফিস এখনও রেডি হয়নি। তাই বাইরে বসলাম।
বৃদ্ধকে ডাকা হলো। আমি সানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বৃদ্ধের আসা দেখলাম। দুই হাতে দুটি লাঠি। লাঠি ভর করে সামনে এগিয়ে আসছেন। দেখলাম, অন্ধ মানুষের মতো মাটির দিকে তাকিয়ে লাঠি ভর করে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছেন।
সালাম দিলেন। আমি চেয়ারে বসতে বললাম। তিনি বসলেন। কিন্তু সোজা হয়ে বসতে পারলেন না। জীবন পরাঘাতে শরীর ভেঙেছে তার। বসেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, বাবা, আমি এক অভাগা পিতা। মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম। ৮ বছর ঘর করেছে। মেয়ের ঘরে বাচ্চা হয়নি। ছেলের সমস্যা। চেষ্টা করেছিল ঘর করার কিন্তু ছেলের মা-বাবা-বোনরা অত্যাচার করে। শেষে জামাইয়ের ঘর ছেড়ে চলে আসে। আসার পর ছেলে স্থানীয় মেম্বারসহ জোর করে ডিভোর্স লেটার লিখে নেয়। বাবা, আমার মেয়ের দেনমোহরের টাকাটাও দেয়নি। আমি চোখে দেখি না। আপনাকেও ঝাপসা দেখছি।
বৃদ্ধের আবেদন এত আবেগপূর্ণ যে, আমি চুপ থেকে শুনলাম। বললাম, একটা দরখাস্ত নিন। তিনি বললেন, আমি তো চোখে দেখি না। তাই দরখাস্ত লিখে দেওয়া হলো। আমি শুধু সমস্যাই শুনি না। শুনি জীবন-জীবিকার কথা। বললেন, সিক্সটি ফাইভে আইএসসি পাস করি। আইয়ুবের আমল। এয়ারফোর্সে জয়েন করি। আমি প্যারাসুট প্রশিক্ষণের সময় নিচে পড়ে যাই। এতে কোমর ডিসপ্লেস হয়ে যায়। আর চাকরিতে যেতে পারিনি। বিছানা আমার জীবন সঙ্গী। ৮০ এর দিকে হাঁটতে-চলতে পারি। তখন বিয়ে করি। মেয়ে হয়। মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিই। তারও কপাল পুড়ল।
আল্লাহর কাছে মানত করি, ছেলের জন্য। ছেলে হয়। সে এখন কুরআনের হাফেজ হচ্ছে।… বললেন অনেক কিছু। জীবনের এ ঢেউয়ের কথা যখন শুনতে চাই, অবলিলায়, সাবলিল ভঙ্গিতে সবই বলেন। আমিও শুনি। তিনিও বললেন। মেয়ের ডিভোর্স নিয়ে তিনি খুবই ভেঙে পড়েছেন। স্থানীয় মেম্বারসহ কয়েকজন মিলে মেয়েকে জোর করে ডিভোর্স দিয়েছে। ভাইয়ের ছেলেকেও মেরেছে। অনেক কিছুই বললেন তিনি।
এর মধ্যে মূলকথা, বাবা দুই কেজি চাল বিক্রি করে আপনার কাছে এসেছি। টিউশনি করে ছেলেমেয়ে পড়িয়েছি। এখন আর পারি না। কোর্টে মামলা করব। উকিল আড়াই হাজার টাকা চায়। এত টাকা আমার নেই। বাবা আমার বিচার না করলে গুলি করে মেরে ফেলেন। আমার মেয়েটা বড়ই অভাগা।
শেষ কথা, আইন আমাকে এ কাজ করার কোনো অনুমতি দেয়নি। এ ঘটনা অনুযায়ী আদালতে মামলা হওয়ার কথা। মানবিকতার কথা চিন্তা করে সমস্যা সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করি। কারও কথা শুনলে আমি আবেগে আপ্লুত হই। এটা হয়তো আমার স্বভাব। আমি শুনি। চেষ্টা করি। যদি কিছুটা করতে পারি!
লেখক: সাহিত্যিক ও এডিশনাল এসপি
সম্পাদনা: আশিক রহমান