অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের নতুন মাত্রা
মোহসীন আব্বাস: অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সামরিক বা কৌশলগত সহযোগিতার ধারণা দক্ষিণ এশিয়ায় ততটা আলোচিত হয় না। তবে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক অনালোচিত হলেও দীর্ঘদিনের। ১৯৪৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সেই থেকে দেশ দুটির মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক বিদ্যমান।
আধুনিককালের রাষ্ট্র হিসেবে অস্ট্রেলিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ। নিউজিল্যান্ড বাদ দিলে, এক দেশেই এক মহাদেশ। পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক। সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সংকটে পশ্চিমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে অংশগ্রহণ আছে। উন্নত অর্থনীতির দেশ। বিপরীতে, শ্রীলঙ্কার কাঁধে সামরিক শাসনের অপবাদ আছে, যুদ্ধাপরাধের অপবাদ আছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপবাদ আছে। তবে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে অব্যাহত অগ্রগতির পথে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। সার্কের অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র, আঞ্চলিক শক্তি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অম্ল-মধুর। একধরনের নীরব থাকার কৌশল আছে শ্রীলঙ্কার। ভারত মহাসাগরে, ভারতের উঠানে বসবাস করেও চীনের মিত্র হিসেবে পরিচিতি আছে। পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কও চোখে পড়ার মতো শীতল নয়।
বিশ্বরাজনীতিতে ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ যতটা আলোচিত, সার্কের অন্যতম প্রধান অর্থনীতি হিসেবে, শ্রীলঙ্কা ততটা আলোচিত নয়। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়তে থাকায় কূটনৈতিক মহলে আলোচনায় আসে শ্রীলঙ্কা।
ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার মানুষে-মানুষে সম্পর্ক শুরু হয়েছে ১৯ শতক থেকে। এছাড়া কমনওয়েলথ, কলম্বো পরিকল্পনা, আসিয়ান এবং সাম্প্রতিক ভারত মহাসাগরীয় রিম অ্যাসোসিয়েশন-এ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। দেশ দুটির মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে অভিবাসন, উচ্চ শিক্ষা ও খেলার জগত নিয়ে। আর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে কৌশলগত সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার।
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক দিকগুলোর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়ে পড়ছে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়গুলো। যার সঙ্গে যুক্ত এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা। আর এই উদ্বেগ দুদেশের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া সম্পতি প্রতিরক্ষা স্বেতপত্র-২০১৬ নামে একটি দলিল প্রকাশ করেছে। এ দলিল শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্ককে ব্যাপকতর করার ভিত্তি দিয়েছে। এখন দুদেশের সম্পর্কের কেন্দ্রে রয়েছে মানবপাচার। এ সম্পর্ক ভবিষ্যতে একটি বিধিসম্মত বর্ধিত সহযোগিতায় উন্নীত হতে যাচ্ছে, যা আঞ্চলিক সম্ভাবনা উন্মোচন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
মানবপাচার রোধে দুদেশ একটি যৌথ কর্ম পরিষদ গঠনের পর অস্ট্রেলিয়া সরকার ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কাকে দুটো উপসাগরে টহলদানে সক্ষম জাহাজ উপহার দেয়। এ উপহার তাদের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি করে। এই উপহারের পোশাকি লক্ষ্য ছিল শ্রীলঙ্কার জলসীমায় মানবপাচার চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে দেশটির নৌবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো। ্ওই সময় বেশ কিছু মানবাধিকার গ্রুপ এ সহযোগিতার সমালোচনা করেছিল। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা স্বেতপত্র সব সমালোচনাকে উপেক্ষা করে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কের নতুন মাত্রার ইঙ্গিত দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা স্বেতপত্র-২০১৬ মূলত দেশটির ২০৩৫ সাল পর্যন্ত দেশটির নিরাপত্তা কৌশলপত্র। এই দলিলের যতটা গণমাধ্যমে এসেছে, সে অনুযায়ী একথা বলা যায় যে, অস্ট্রেলিয়া শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের বৃহত্তর ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। অস্ট্রেলিয়া মনে করছে, নিরাপদ অস্ট্রেলিয়ার জন্য সীমান্ত রক্ষীদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে; নিরাপদ নিকট অঞ্চলের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলে নৌ-সহযোগিতা বাড়াতে হবে; আর স্থিতিশীল ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য দরকার নীতি নির্ভর বিশ্ব ব্যবস্থা। এ ছাড়াও দলিলে আরও বলা হয় ছটি বিষয় আছে, যার ভিত্তিতে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা-পরিবেশ গড়ে উঠবে। এগুলো হলো চীন-মার্কিন সম্পর্ক; নীতিভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা, যার মধ্যে বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে অন্যান্য দেশের প্রতিযোগিতার ধরণ নির্দ্দিষ্ট হবে; সন্ত্রাসবাদ; অসম প্রবৃদ্ধির জন্য দুর্বল রাষ্ট্রের আবির্ভাব, অপরাধ, সুশাসনের বাধা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব; আঞ্চলিক সামরিক শক্তির বিকাশ এবং অভৌগোলিক হুমকি, যেমন সাইবার হুমকি।
অস্ট্রেলিয়ার এই দলিলের ভেতরে লুকানো আছে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনের কলাকৌশল। মানবপাচার এবং সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর কৌশল এখনই কম বেশি কার্যকর। দুদেশ মানবপাচার রোধে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় দুদেশই মনে করছে তাদের মৎস্য সম্পদে অবৈধ দখল রয়েছে। এ নিয়ে তো ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মন কষাকষিও আছে। আরও কথা বলা হয়েছে অস্ট্রেলীয় দলিলে। সাগরে অপরাধ দমনে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। তা আগামীতে আরও বাড়বে যৌথ সামরিক মহড়া, তথ্য ও জ্ঞানের আদান প্রদান এবং অভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক ও কিছু সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়নের কাজ চলছে।
অস্ট্রেলিয়ার দলিলে প্রতিবেশীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর ভিত্তিতে পাপুয়া নিউগিনি, তিমোর-লেসেথে এবং বিভিন্ন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত অংশীদার। এদের বেশিরভাগই দুর্বল রাষ্ট্র। শ্রীলঙ্কার প্রতিবেশী মালদ্বীপকেও একই কাতারের দেশ হিসেবে বিবেচনা করে অস্ট্রেলিয়া। কৌশলপত্রের ভিত্তি অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়া তার কৌশলগত সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী মালদ্বীপ পর্যন্ত। আর এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাই হতে পারে এ অঞ্চলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
মালদ্বীপের রাজনীতি নিয়ে ভারত-শ্রীলঙ্কা টানাপড়েন আছে। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটে ভারতের ভূমিকায় ততটা খুশি নয় দেশটি। এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া শ্রীলঙ্কার মাতের সমর্থক। অস্ট্রেলিয়া ভূরাজনীতির এ খেলায় সরাসরি অংশ নিতে চাইবে না। বরং শ্রীলঙ্কাকে কৌশলগত অংশীদার হিসাবে পেলে সুবিধা বেশি। এ ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়া ব্যবহার করতে পারে দুর্বল রাষ্ট্রকে সহযোগিতার কৌশল, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত দেশকে সহায়তার কৌশল ।
আঞ্চলিক নিরাপত্তার ইস্যুতেও অস্ট্রেলিয়া পাশে চায় শ্রীলঙ্কাকে। শ্রীলঙ্কা এ আকাক্সক্ষাকে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি বলে মানে। অস্ট্রেলিয়ার জন্য এ নিরাপত্তা অঞ্চল পূর্ব আফ্রিকা থেকে পূর্ব এশিয়া হয়ে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিশাল অঞ্চলের মধ্যভাগে শ্রীলঙ্কার মতো স্থিতিশীল দেশকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে পেতে চাইবে অস্ট্রেলিয়া, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এক্ষেত্রে, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত অস্ট্রেলিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী।
চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকট উপস্থিতি, চীনের অর্থনৈতিক উত্থান, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার শীতল বন্ধুত্ব অস্ট্রেলিয়াকে শ্রীলঙ্কার প্রতি আগ্রহী করেছে। এদিকে অর্থনৈতিক খাতে শ্রীলঙ্কা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণতর করতে চায়। উচ্চ শিক্ষা, পর্যটন ও শিল্পকলার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। এরপরও বিশেষ বিবেচনার বিষয় হলো শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কোনো দেশেরই কৌশলগত সহযোগিতার চুক্তি নেই। শ্রীলঙ্কার মৌল নীতি হলো বহু দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পথ চলা। বিশেষ করে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় দেশটি।
শ্রীলঙ্কার ভৌগলিক অবস্থান দেশটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। দুটো আঞ্চলিক জোট- সার্ক ও আসিয়ানের সীমান্ত-রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ভারত মহাসাগরীয় সমুদ্রপথের ওপরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা। আর ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রও অস্ট্রেলিয়ার মতোই নীতিনির্ভর বিশ্ব ব্যবস্থা প্রত্যাশা করে। এমন পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার হবে, এটাইতো স্বাভাবিক। তথ্যসূত্র: দ্য ডিপ্লোমেট।