পরমতসহিষ্ণুতা : মানব জীবনের অপরিহার্য গুণ
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
অপরের মত, পরামর্শ, ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসের প্রতি ইসলাম সব সময় শ্রদ্ধাশীল। গঠনমূলক সমালোচনাকে ইসলাম সব সময় স্বাগত জানায়। ভিন্ন মতের প্রতি ইসলামের আচরণ সহানুভূতিপূর্ণ। কারণ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে সুষ্ঠু সমাজ গঠন ও পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সহিষ্ণুতা নিঃসন্দেহে মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এবং সামাজিক মূল্যবোধ নির্মাণের তাৎপর্যপূর্ণ বুনিয়াদ। অপরের কথা, বক্তব্য, মতামত, পরামর্শ ও জীবনাচার যতই বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হোক না কেন তা সহ্য করার মতো ধৈর্য ও স্থৈর্য যদি মানুষের মধ্যে না থাকে তাহলে সমাজে নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে বাধ্য। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে আধিপত্যবাদ, স্বৈরাচার সমাজ ও রাষ্ট্রে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
তাই যে জাতি যত বেশি সহনশীল ওই জাতি তত বেশি সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও অগ্রসর। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন, আস্থা অর্জন ও সৌহার্দ্য সৃষ্টির জন্য পরমতসহিষ্ণুতার গুণ অপরিহার্য পূর্ব শর্ত। পবিত্র কুরআন সহিষ্ণুতার মহৎ গুণটি অর্জনের জন্য জোরালো ভাষায় তাগিদ দিয়েছে। মহানবি হজরত মুহাম্মদ সা. ও মহান চার খলিফা নিজেদের জীবনে পরের মতামত ও বিশ্বাসের প্রতি নমনীয় ও সহানুভূতিপ্রবণ ছিলেন, ইতিহাসে তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে এটা সঠিক তবে সেটাকে ব-াহীন করেনি। কারণ কোনো উগ্র মতামত ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য যদি অপরের, দলের, জাতির, গোষ্ঠীর ও ধর্মের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে আহত করে অথবা সমাজে ফিৎনা-ফ্যাসাদের জন্ম দেয় তাহলে তা বর্জনীয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তারা সত্যের আদেশ দেয় এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখে।’
উপর্যুক্ত গুণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না। বর্ণিত আয়াতে কেবল ওই স্বাধীনতার গ্যারান্টিই নিশ্চিত করে না বরং এই স্বাধীনতাকে ব্যবহার করার পথও নির্দেশ করে দেয়। একজন মুসলমান মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কেবল সত্য ও কল্যাণের বিকাশে ব্যবহার করতে পারেন। অসত্য ও অন্যায় প্রচারে এই স্বাধীনতা ব্যবহৃত হতে পারে না। কারণ এটা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা অন্যায়ের আদেশ দেয় এবং সত্য ও কল্যাণে বাধা দান করে।’ আত-তাওবা: ৬৭
পবিত্র কুরআনে বনি ইসরাইলের পতনের অন্যতম কারণ নির্দেশ করে বলা হয়েছে, ‘তারা যেসব গর্হিত কাজ করত তা হতে তারা একে অন্যকে বারণ করত না। তারা যা করত তা কতই না নিকৃষ্ট।’ আল মায়িদা: ৭৯
মহানবি সা. বলেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা-ন্যায় কথা বলা উত্তম জিহাদ।’ আবু দাউদ, তিরমিজি।
ইতিহাস এ কথা স্পষ্ট সাক্ষী দেয়, মদিনা প্রজাতন্ত্রের জনগণ নির্বিঘœ ও নির্ভয়ে মহানবি হজরত মুহাম্মদ সা. ও চার পুণ্যবান খলিফার সামনে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারতেন। মহানবি সা. এর অভ্যাস ছিল বিভিন্ন বিষয়ে তিনি সাহাবায়ে কেরামের মতামত নিতেন এবং মত প্রকাশে উৎসাহিত করতেন। ওহুদের যুদ্ধের সময় মহানবি সা. এবং বিশিষ্ট সাহাবাদের মত ছিল মদিনা শহরের অভ্যন্তরে অবস্থান করে শত্রুর সাথে যুদ্ধে অবতর্ঢু হওয়া, কিন্তু হজরত হামযাহ রা. এবং অপেক্ষাকৃত যুবক সাহাবিগণ শহরের বাইরে কোনো উন্মুক্ত প্রান্তরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। রাসুলুল্লাহ সা. তাদের এই মতামত গ্রহণ করে ওহুদের প্রান্তরে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে অবতর্ঢু হন। একদা মহানবি সা. যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করছিলেন। একজন বলে ওঠেন, ‘গনিমাতের বণ্টন আল্লাহর ইচ্ছের পরিপন্থী হয়েছে।’ রাসুলুল্লাহ সা. কেবল জবাব দিলেন, ‘আমি যদি ইনসাফ না করি তাহলে ইনসাফ করবে কে?’ কিন্তু ভিন্ন মত পোষণকারীদের মুখ বন্ধ করে দেননি।
হজরত যুবায়ের রা. এবং এক আনসারির মধ্যে সৃষ্ট বিরোধের এক মামলা বিশ্বনবির সা. আদালতে প্রেরিত হয়। সাক্ষী প্রমাণ ও তথ্যাদি যাচাই করে বিশ্বনবি সা. হজরত যুবায়েরের অনুকূলে রায় প্রদান করেন। কন্তু আনসারি ক্রোধান্বিত হয়ে মন্তব্য করেন, ‘আপনি ফুফাতো ভাইয়ের পক্ষে রায় দিলেন।’ এটা ছিল বিশ্বনবির সা. সততা ও ন্যায় ইনসাফের প্রতি খোলা চ্যালেঞ্জ, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা. তাকে ক্ষমা করে দেন। ভিন্ন মতের জন্য কোনো শাস্তি দেননি। এক যুদ্ধ অভিযানের সময় মহানবি সা. মুসলমানদের হুকুম দিলেন, অমুক অমুক জায়গায় তোমরা শিবির স্থাপন করো। এক সাহাবি জানতে চাইলেন এই হুকুম কি আল্লাহপ্রদত্ত ওহি, না আপনার ব্যক্তিগত অভিমত? রাসুল সা. বলেন! এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সাহাবি উত্তর দিলেন অমুক জায়গা শিবির স্থাপনের উপযোগী নয় বরং এর পরিবর্তে অমুক অমুক স্থান ক্যাম্প স্থাপনের উপযোগী এবং সহায়ক। আল্লাহর রাসুল নিঃসঙ্কোচে সাহাবির এই অভিমত মেনে নেন।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা. মতামতের স্বাধীনতা অনুমোদন করে জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাকে অনুসরণ করো যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুসরণ করব। যদি আমি গোমরাহির পথে পরিচালিত হই তবে তোমরা আমাকে সঠিক পথের দিশা দেবে।’ হজরত উমর রা. ক্ষমতায় থাকাকালীন বক্তৃতারত অবস্থায় মদিনার জনগণকে বলেন, ‘আমি যদি ভুল পথে পরিচালিত হই তখন তোমরা কী করবে?’ তাৎক্ষডুকভাবে একজন উত্তর দিলেন, ‘এই তরবারি দিয়ে সোজা পথে নিয়ে আসবা’। পরমতসহিষ্ণুতার এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে দুনিয়াবাসী অভিভূত হয়েছে। হজরত উমরের রা. খিলাফতকালে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রাদেশিক গভর্নরের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মতামত ও অভিযোগ পেশ করতে পারতেন। যেকোনো নাগরিকের ভিন্নমত প্রকাশে বাধা দেয়া হতো না। হজরত আমর ইবনে আস রা. হজরত মুগিরা ইবনে শো’বা রা. হজরত আবু মুসা আশআরি রা. ও হজরত সা’দ ইবনে ওয়াক্কাসের রা. মতো খ্যাতনামা প্রাদেশিক গভর্নরদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো হজরত উমর রা. প্রকাশ্যে জনসমক্ষে শুনানি করতেন। (ইষৎ সংক্ষেপিত)
লেখক: অধ্যাপক, ওমরগণি ওএমএস কলেজ, চট্টগ্রাম