সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গ এবং সনাতন ধর্ম
স্বামী স্থিরাত্মানন্দ
শাস্ত্রে যাকে ‘আততায়ী’ বলে তাকেই বর্তমান সমাজে ‘সন্ত্রাসী ও জঙ্গি’ নামে বলা হয়ে থাকে। নিজে বেঁচে থাকার অধিকার সকলেরই আছে। আত্মরক্ষার জন্য সবকিছুই করা যায়। তবে অন্যের কল্যাণ করতে গিয়ে যদি আত্মত্যাগ করা হয় তবে তা হয় মহৎ কাজ।
আততায়ীর হাত থেকে বাঁচার জন্য সনাতনধর্ম শাস্ত্র মনুসংহিতা পরামর্শ দিয়েছেন। আততায়ী কাকে বলে? যে ঘরে আগুন দেয়, যে অন্যকে বিষ দেয়, হত্যা করার জন্য অস্ত্রধারণ করে, ধন অপহরণ করে, ভূমি অপহরণ করে ও স্ত্রী-কন্যা অপহরণ করেÑ এই ছয়জন আততায়ী। প্রকাশ্যভাবেই হোক বা অপ্রকাশ্যভাবেই হোক আঁততায়ীকে বধ করলে সেই বধকারীর কোনো দোষ হয় না। (মনুসংহিতা ৮ম/৩৫১)
মনুসংহিতা (৮ম/৩৫০) আরও বলেছেন, গুরুই হোক, বালকই হোক, বৃদ্ধই হোক, কিংবা অতি বড় বেদবিদ্যাসম্পন্ন ব্রাহ্মণই হোক, এদের মধ্যে কেউ যদি হত্যা করার জন্য আক্রমণ করে, তাহলে কোনোরকম বিবেচনা না করে তাকে অবশ্যই বধ করবে।
কিন্তু আঁততায়ী ছাড়া অন্যকে কায়, মন ও বাক্যে আঘাত করাকে ধর্ম বলা হয় না, সেটা অধর্ম। এজন্য ঈশ্বরের উত্তম ভক্তের লক্ষণে বলা হয়েছে, সকল প্রাণীকে বিদ্বেষ না করে উত্তম ভক্ত হতে হয়। (গীতা ১৩/১২শ) শরীর দিয়ে, মন দিয়ে, বাক্য দিয়ে কাউকে ঘৃণা করা অধর্ম এবং তার ফল দুঃখ। কারণ সকল অধর্মের ফলই দুঃখ আর ধর্মের বা পুণ্যের ফল হলো সুখ। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ; শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম, কাপুরুষতাই পাপ; স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। অপরকে ভালোবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বরে এবং নিজ আত্মাকে বিশ্বাসই ধর্ম, সন্দেহই পাপ। অভেদ দর্শনই ধর্ম, ভেদ দর্শনই পাপ।
মহাভারতে ব্যাসদেবের একটি বাক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, স্বামী বিবেকানন্দও সেটি উদ্ধৃত করেছেন। বলেছেন, সকল শাস্ত্রে, পুরাণে ব্যাসদেবের দুটি বচন খুব গুরুত্বপূর্ণ, এ দুটি হলোÑ পরের উপকার করলে পুণ্য হয়, আর পরকে পীড়ন করলে, নির্যাতন করলে পাপ হয়। অন্যকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করা শরীরের দ্বারা নির্যাতন, অন্যকে ভয় দেখানো বা হুমকি দেওয়া হলো বাক্যের দ্বারা নির্যাতন, মনে মনে কারও অনিষ্ট চিন্তা করা হলো মনের দ্বারা নির্যাতন বা পীড়ন। এগুলো পাপকর্ম এবং নির্যাতনকারী দুঃখরূপ ফল ভোগ করে। সুতরাং সনাতন ধর্ম কখনই নির্যাতন করাকে, হুমকি দেওয়াকে, নিরীহ মানুষকে হত্যা করাকে, ধর্ম বলে না।
ভগবানের যিনি উত্তম ভক্ত তিনি কাউকে উদ্বিগ্ন করতে পারেন না বা কাউকে উদ্বিগ্নও করতে পারেন না। গীতাও উত্তম ভক্ত হবার গুণ বলা হয়েছে, যিনি কারও দ্বারা উদ্বিগ্ন হন না, কারণ ঈশ্বর সকলের হৃদয়েই আছেন এবং তিনিও কারও কাছ থেকে উদ্বেগ প্রাপ্ত হন না, তিনিই ভগবানের প্রিয় ভক্ত। আর তিনি, ‘সর্বভূতহিতে রতাঃ’ (গীতা ৪/১২শ), সকল প্রাণীর কল্যাণে তিনি রত থাকেন।
গীতার ১৬শ অধ্যায়ে দৈবী সম্পদ (১-৩) ও আসুরিক সম্পদ (৪-৫) বিভাগ করা হয়েছে। দৈবী সম্পদ বা গুণাবলি যেমন, অন্তরশুদ্ধি, ইন্দ্রিয় মনের সংযম, দান করা, তপস্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধÑ এগুলো জীবনে অর্জিত হলে মানুষ আনন্দময় জীবনযাপন করতে পারে। অন্যদিকে আসুরিক সম্পদ যেমনÑ দম্ভ, দর্প, ক্রোধ, কর্কশ ব্যবহার, অজ্ঞান এসব দোষগুলো পরিহার করে আমরা ধর্মবিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী সকলেই নিজেরা ভালো হতে পারি এবং অন্যের কল্যাণে রত থাকতে পারি। আনন্দময় জীবনের জন্য এ দোষগুলো পরিহার করা প্রয়োজন।
সনাতন শাস্ত্র বেদের উপনিষদে মানুষের মনের চিন্তাজগতে যে ভালো ও মন্দের মধ্যে সংগ্রাম তাকেই দেবতা ও অসুরের সংগ্রাম হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্তর জগতের সেই সংগ্রামই বাইরের জগতে মানুষে মানুষে সংঘাতের সৃষ্টি করে। কিন্তু এই মনই যখন পরম ঈশ্বরের চিন্তা করে, তার নাম গুণগান করে, তার কাছে আত্মসমর্পণ করে তখনই মন ঈশ্বরের কৃপায় সমস্ত আসুরিক ভাব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। দুর্গাপূজার প্রতিমাতে এই ভাবটি তুলে ধরা হয়েছে। ঈশ্বরের অনন্ত ভাব। একটি ভাব হলো মাতৃভাব। ঈশ্বরকে কেউ মা বলে ডাকতে পারে। কাম, ক্রোধ, লোভÑ এগুলোই অসুর। ঈশ্বরের শরণাগত হলে এসব অসুর ধ্বংস হয়, মানুষ নিরাপদ হয়। ঈশ্বরের কৃপালাভে অন্তর শুদ্ধ করার জন্যই মানুষ বিভিন্ন সাধনা করে থাকে।
সেবাকর্ম হলো ধর্মের ব্যবহারিক দিক। গীতায় ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের সেবার বিষয় আছে। শ্রী ভগবান বলছেন, (১৪শ/২৬) যে আমাকে ভক্তিভাবে সেবা করে, সে পরম কল্যাণ লাভ করে। ভগবান কোথায় থাকেন যে তার সেবা আমরা করতে পারব? শ্রী ভগবান বলছেন, (গীতা ১৮শ/৬৮) ঈশ্বর সকল প্রাণীর হৃদয়ে থাকেন। তিনি শুধু হিন্দুদের হৃদয়ে থাকেন তা কিন্তু বলেননি। সুতরাং ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের সেবা, এমনকি সকল প্রাণীরই সেবা ঈশ্বরেরই সেবা। স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলেছেন, জীবেপ্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। এইরকম সেবা যেখানে হয়, সেখানে ভালোবাসাই বিরাজ করে, সন্ত্রাস বা হুমকি বা হত্যার ভয় থাকতে পারে না। সকল ধর্মের প্রায়োগিক দিক এরকম ভালোবাসা ও সেবাই পারে সন্ত্রাস বা হত্যাকে সমূলে বিনাশ করতে। তাই আমাদের চাই প্রকৃত ধর্মবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া, মহাপুরুষদের হৃদয়কে অনুসরণ করা, সকলের কল্যাণকর্মে নিযুক্ত থাকা।
লেখক: সহ-সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা / সম্পাদনা: আশিক রহমান