শিল্পকলায় নৃশংসতার নন্দনতত্ত্ব
চারুকলার সামনে বসে হালকা পাতলা একটি ছেলে কিছু চিবিয়ে খাচ্ছে। প্রথমে আশেপাশের লোকজন বুঝতে পারে না ঠিক কি হচ্ছে। কেউ কেউ কৌতূহলি হয়ে ধীরে ধীরে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যায়। এমনিতেই ইদানিং রাষ্ট্রে রকমফের পাগলের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তাই ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।
অবাক কা- ছেলেটি কাঁচামাংস চিবিয়ে খাচ্ছে। ভিড় করা লোকজন একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেÑ কি খায়! অন্য একজন ঠোঁট উল্টে অবজ্ঞা মিশ্রিত বিস্ময় নিয়ে উত্তর দেয়, মনে হয়তো সত্যি সত্যিই কাঁচামাংস খাইতেছে। মাংস খেয়ে যাওয়া ছেলেটির পাশে দাঁড়ানো কয়েকটি মধ্যবিত্ত গোছের ছেলেমেয়ে। তাদেরকে একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করে, ভাই উনার কি হইছে? পাগল নাকি? ওদের মধ্য থেকে একজন উত্তর দেয়Ñ উনি আর্টিস্ট। পারফরমেন্স করে।
পাঠক এই আর্টিস্ট ছেলেটির নাম সোহেল। পুরো নাম ইমরান সোহেল। যিনি বর্তমানে নিয়মিত পারফরমেন্স করছেন। তার এই ধরনের কাজ করার কারণ খোঁজার আগে একটু পেছনে যেতে চাই। শিল্পের ইতিহাসে তাকালে নৃশংসতার দৃশ্যরূপ নির্মাণ নতুন নয়। গুহাচিত্রে আদিম মানুষের পশু শিকার বাঁচার অধিকার হিসেবে, সুমেরীয়দের মানুষ হত্যার দৃশ্য ক্ষমতা-কাঠামোর প্রাথমিক স্তর হিসেবে সভ্যতায় স্বীকৃতি পেয়েছে। মধ্যযুগীয় শিল্পকলায় এই হত্যাদৃশ্য সংকুচিত হয়ে একটি বিপরীতনীতি গ্রহণ করে। শাসকের ক্ষমতা-সৌন্দর্যের দৃশ্যরূপ নির্মিত হতে শুরু করে। বিজয়ী শাসক এর নির্মাতা। তিনি স্পেসের কেন্দ্রে অবস্থান করেন তার ঐশ্বর্য রক্ষার নীতিমালা নিয়ে। যা ঈশ্বর তথা রাজার আকাক্সক্ষা। এর বিনষ্টির আড়ালে হত্যা মানসিক ভীতি হয়ে প্রচারিত হতে থাকে।
তাই গুপ্তযুগে যে বরাহ অবতারের দেখা মেলে, তিনি বোধকরি শাসকের অনুকূলে হিরণ্যাক্ষ নামক রাক্ষসকে হত্যার কাজটি করছেন। নির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে সেখানে প্রকাশ্য হত্যা দৈবকা-ে স্বীকৃত। যা পরবর্তী শাসক ঘেঁষা শিল্পীদের হাতে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। তবে মধ্যযুগীয় দৈবিক হত্যার স্বীকৃতি বিরোধিতার মুখে পড়ে গয়্যার চিত্রে। গ্রিক মিথের শাসক ক্রোনাসকে গয়্যা হত্যাকারী হিসেবে তার কাজে পুনঃপরিচিত করান। এখানেও হত্যার গল্প বলা হয়। তবে প্রাচীন ভারতের বরাহ অবতারের মতো কোনো হত্যাকারীর স্বীকৃতি নয় বরং গয়্যা শাসকের জিঘাংসাকে এখানে উন্মোচন করেন। স্যাটার্ন চিরস্থায়ী ক্ষমতা লাভের জন্য নিজের সন্তানদের একের পর এক হত্যা করে। গয়্যার এই নির্মাণ তার ব্যক্তিগত ও সমসাময়িক রাজনীতির মনোঃসমীক্ষণ হাজির করে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের বাস্তবতা ও তার নিজস্ব মনঃপীড়নের প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ উন্মোচন করে এই হত্যাদৃশ্য? এবং একই সঙ্গে গ্রিক মিথের ক্রোনাস থেকে স্যাটার্নে রূপান্তরের ইতিহাসকে প্রশ্ন করে। তিনি এর মাধ্যমে শাসকের মধ্যযুগীয় সুন্দর ইমেজের মুখোশও উন্মোচন করেন। যেমনটা দেখা যায়, পরবর্তী সময়ে আন্দ্রে সেরানোর ‘চরংং ঈযৎরংঃ’, (১৯৮৭) নামক কাজে শাসক ইমেজকে বাতিল করার প্রক্রিয়ায়।
উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ ভাষা খুঁজেছে গ্রিসিয় অভিজাতদের পরিপাঠ্য সুন্দরের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। যে সুন্দর শাসকের শরীরের ন্যায় পেলব। তাতে আসন্ন গণতান্ত্রিক যুগের আভাস মেলে, কিন্তু দৃশ্যশিল্পে একইসঙ্গে হত্যার স্বীকৃতিও। স্পেনের গৃহযুদ্ধের কালের শিকার মানুষেরা বা আন্দ্রের যুগের আমেরিকার বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা হয়তো এই হত্যার পক্ষাবম্বন করেন এবং এর মধ্য দিয়ে কি দৃশ্যশিল্পের প্রাক্তন ইতিহাসবিরোধী আরেক হত্যাকা-ের সূচনা ঘটে, যাকে আরও সম্প্রসারিত করেন ড্যামিয়েন হার্স্ট? ড্যামিয়েন হার্স্ট তার ‘ঞযব চযুংরপধষ ওসঢ়ড়ংংরনরষরঃু ড়ভ উবধঃয রহ ঃযব গরহফ ড়ভ ঝড়সবড়হব খরারহম’ (১৯৯১) কাজটিতে একটি বৃহৎ হাঙ্গরকে ব্যবহার করেছেন। যেখানে শিল্পী নিজে একটি নৃশংসতার নতুন মিথ তৈরি করেছেন, পুরনো মিথে আশ্রয় করে নিজস্ব বাস্তবতা প্রকাশ করার বদলে। এখানে শিকার ও শিকারির নৃশংসতা উপস্থাপনের বদলে ঠা-া মনস্তত্ত্বে শিল্পী স্বয়ং নৃশংস হয়ে ওঠেন। অ্যান্ডি ওয়ারহলের ‘ঙৎধহমব ঈধৎ ঈৎধংয ঋড়ঁৎঃববহ ঞরসবং’ (১৯৬৩) কাজের মাধ্যমে তিনি তার সময়ের মানুষের যে মনস্তাত্ত্বিক নিষ্ক্রিয়তাকে উন্মোচন করেন তারই একটি শিকার কি ড্যামিয়েন হার্স্ট?
বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্পের ইতিহাসে বরাহ অবতারের নন্দনতত্ত্ব আবার আঁচড়ে পড়ে পশ্চিমাদের হাত ধরে। অনেকের মধ্যে শিল্পী মাহবুবুর রহমানের কাজেও এর দেখা মেলে। বরাহ অবতার বা গয়্যার স্যাটার্ন মাহবুবুর রহমানের দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসে (‘ঘবি ঝবষভ-ংষধঁমযঃবৎ’ ২০০৬) আত্মঘাতী হয়ে যায়। হত্যা এখানে ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনায় মুখর। এমনকি তা ড্যামিয়েন হার্স্টের মতো আধুনিক মানুষের জিঘাংসাকেও প্রশ্ন করে।
দ্বিমাত্রিক স্পেসে আইরনি নির্মাণ বা জড়বস্তুর নৃশংস দৃশ্যরূপের শিল্প এলাকা থেকে পশ্চিমা পারফর্মারদের হাত ধরে এখানে শিল্পীরা প্রাণী হত্যা, নিজেকে রক্তাক্ত করার মাধ্যমে নতুন যুগের রিচ্যুয়ালের সূচনা করে। নিজেদের রিচ্যুয়াল থেকে আলাদা করা এবং পশ্চিমাদের নব্য-বাস্তবতায় শিল্পের জন্য শিল্পের দৃঢ় মনোভাবের রিচুয়্যালকে বোঝা ও তার সঙ্গে সংযুক্তির চেষ্টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা শৈলী হিসেবে এদেশের শিল্পীদের অনুপ্রেরণা যোগায়। এসবের পরেও এই সময়ে মাহবুবুরের আত্মঘাত বা সিরিয়াল কিলারের মতো ঠা-া মাথার শিল্পীর হাঙ্গর হত্যার সীমানা ছাড়িয়ে, শিল্পী নিজেই যখন বরাহ বা স্যাটার্নের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চান, তা কি শুধুই শৈলীগত অণুপ্রেরণা?
একের পর এক নাস্তিক হত্যার বিপরীতে চারুকলার সামনে এককভাবে বা ধর্মীয় উন্মাদনা ও হত্যার বিপরীতে রোজার দিনে টিএসসিতে প্রকাশ্যে যৌথভাবে শিল্পী বুলবুলের সঙ্গে শিল্পী সোহেল যখন নিউমার্কেট থেকে না ধোয়া কাঁচামাংস খেতে শুরু করেন তখন কি তিনি নিজেই গয়্যার বাস্তবিক স্যাটার্ন হয়ে উঠতে চান এবং নিস্পৃহতার বিপরীতে নির্মাণ করেন নৃশংসতার নন্দনবোধ? নৃশংসতা নৃশংসতার জন্ম দেয়। এসব কাজে সেই প্ররোচক বাস্তবতার মনস্তাত্ত্বিক দিকটি উন্মোচিত করে প্রশ্ন করেন কি তিনি বিকারহীন নিস্পৃহ প্রত্যেকটি মানুষের ভিতরের স্যাটার্ন চরিত্রটিকে? যার শিকার শিল্পী নিজেও।
সম্পাদনা: আশিক রহমান