জাতি মেধাশূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে
ইকতেদার আহমেদ
বাংলাদেশ ভূ-খ-ে বসবাসরত নাগরিকদের পরিচিতি ’৭২-র সংবিধানে ‘বাঙালি’ মর্মে উল্লেখ ছিল। অতঃপর দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ এর মাধ্যমে সংবিধানে সংশোধনী আনয়ন করে বলা হয়, বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন। সর্বশেষ সংবিধান পঞ্চদশ সংশোধন আদেশ দ্বারা বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলে পরিচিত হবেন।
পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে ভূ-খ-ের ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারিত হয় যেমনÑ আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাগরিকগণ জাতি হিসেবে বাঙালি হলেও তাদের জাতীয়তা ভারতের নাগরিক বিধায় ভারতীয়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী প্রভৃতি জেলায় বিভিন্ন ধরনের উপজাতির বসবাস রয়েছে, যেমনÑ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, হাজং, সাঁওতাল, রাখাইন প্রভৃতি। উপরোক্ত প্রতিটি উপজাতির পৃথক জাতিসত্তা থাকলেও আমাদের সংবিধান অনুযায়ী তারা জাতি হিসেবে বাঙালি। অনুরূপ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিপুলসংখ্যক বাঙালি বসবাস করে কিন্তু তাই বলে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী তাদের জাতীয়তা বাঙালি নয় তারা ভারতীয় নামেই অভিহিত। বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী ব্যতীত বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠীকে সংবিধানে বাঙালি হিসেবে অভিহিত করায় তাদের আত্মপরিচয় বাঙালির মধ্যে হারিয়ে গেছে।
যেকোনো জাতির মধ্যে মেধাবী লোকের সংখ্যা যতবেশি হবে সে জাতি সেভাবে জ্ঞান, বিজ্ঞান, ভাষা, কৃষ্টি, শিল্প ও সাহিত্যে ততবেশি সমৃদ্ধশালী হবে। পৃথিবী বিখ্যাত সাম্রাজ্য বিজয়ী নেপোলিয়নের জাতি বিষয়ে উক্তিÑ ‘তোমরা আমাকে ভালো মাতা দাও, আমি তোমাদের ভালো জাতি দিব।’ নেপোলিয়ন ফরাসি নাগরিক ছিলেন। তার জীবনের শেষ দিকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বৃটিশদের দ্বারা বন্দি জীবনযাপন করলেও ফরাসি জাতিকে পৃথিবীর বুকে একটি আদর্শ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার অনন্য অবদান ছিল।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের শিশুরা জন্ম পরবর্তী মাতৃস্নেহে লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে ওঠে। তাই যেকোনো শিশুর মাতা একজন আদর্শ নারী হলে সে শিশুর আদর্শ নাগরিক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর।
পৃথিবীর সকল সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে মেধার ভিত্তিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও সে শিক্ষা গ্রহণের জন্য সাধারণ মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের সকল নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভালো ও উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ সবার জন্য অবারিত নয়। এ সকল রাষ্ট্রে ভালো ও উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হলে প্রাথমিক যোগ্যতা হলো মেধা আর দ্বিতীয়টি হলো আর্থিক সামর্থ্য।
দেশের রাজধানী শহরের বিভিন্ন স্বনামধন্য স্কুলে প্রথম শ্রেণি হতে পরবর্তী উচ্চতর শ্রেণিসমূহে ভর্তির ক্ষেত্রে অতীতে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীরা কৃতকার্য হয়ে ভর্তির সুযোগ লাভ করত। বিগত তিনবছর যাবৎ স্বনামধন্য স্কুলসমূহের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে লটারির মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। এতে দেখা যাচ্ছে, মেধাবীরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়ে যাচ্ছে আর অপরদিকে মেধাহীনরা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও স্বনামধন্য স্কুলে অধ্যয়নের সুযোগ পাচ্ছে। এ পদ্ধতিটি যে এ সকল স্বনামধন্য স্কুলের সার্বিক গুণগতমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষিত ও সচেতন জনমানুষ উপলব্ধি করতে সমর্থ হলেও সরকারের নীতির কাছে তারা অসহায়।
অতীতে প্রথম শ্রেণি হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ পদ্ধতিতে অধ্যয়ন সমাপ্তের পর একজন ছাত্র বা ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষানামক গণ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেত। এ গণ পরীক্ষাটি সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়। বিগত কয়েক বছর যাবৎ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের গণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যতীত অপর সকল বিষয়ে সাধারণ পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতিটি সরকারের শিক্ষানীতির একটি অংশ। এ পদ্ধতিটি ছাত্র-ছাত্রীদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশে অধিক সহায়ক, শিক্ষানীতির প্রবক্তারা এমন দাবি করে আসছেন। তাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাসের হার বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। শিক্ষকদের প্রতি এ বিষয়ে অলিখিত যে নির্দেশনা রয়েছে তা হলোÑ উত্তরপত্র পরীক্ষণের সময় উদারতা যেন প্রাধান্য পায়। আর তাই এ বিষয়ে শিক্ষকদের মন্তব্য পাশের হার বেশি দেখাতে গিয়ে উদারতাকে প্রাধান্য দেওয়ায় শিক্ষার মান নিম্নমুখী হচ্ছে।
সম্প্রতি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি অধ্যয়ন সমাপনান্তে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার প্রবর্তন করা হয়েছে। উভয় পরীক্ষা অতীতের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ন্যায় সরকারের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড পরিচালনা করে থাকে। এ দুটি পরীক্ষায়ও সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসৃত হয়। সৃজনশীল পদ্ধতিটি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অতীতের সনাতন পদ্ধতির চেয়ে অধিক উপযোগী, এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য দেখা যায়, উভয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার উর্ধŸমুখী রাখার ব্যাপারে উত্তরপত্র পরীক্ষণে নিয়োজিত শিক্ষকদের প্রতি কর্তৃপক্ষের অলিখিত নির্দেশনা থাকে। এর ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, একজন পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র কাক্সিক্ষতমানের না হলেও তা তাকে কাক্সিক্ষতমানের উর্ধেŸ মূল্যায়নের জন্য সহায়ক হচ্ছে। এভাবে একজন ছাত্র বা ছাত্রী বিভিন্ন গণ পরীক্ষায় অতি মূল্যায়িত হয়ে পাশের হার উর্ধŸমুখী দেখানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখলেও তা যে তার সেভাবে মেধার উৎকর্ষসাধনে সহায়ক হচ্ছে না সে উপলব্ধিটুকু ছাত্র-ছাত্রীসহ তাদের অভিভাবক ও শিক্ষক সকলেরই রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভালো ছাত্রছাত্রীরা ঠিকই অধ্যয়নের সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকরা দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে এবং অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগপৎভাবে শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকায় তাদের অনেকের পক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিকভাবে পাঠদান সম্ভব হয় না। এ কারণে দেখা যায়, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের গণ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের মেধার যথাযথ বিকাশ ঘটিয়ে আগামী দিনে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেভাবে যোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না।
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ক্যাডার পদে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক সংস্থা সরকারি কর্মকমিশন দায়িত্বপালন করে থাকে। এ সকল নিয়োগে দেখা যায়, কোটা পদ্ধতি অনুসরণের কারণে অর্ধেকেরও অধিক সংখ্যক পদ পূরণের ক্ষেত্রে মেধা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কোটার বর্তমান যে বিভাজন তাতে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য শতকরা ৩০ ভাগ, মহিলাদের জন্য শতকরা ১০ ভাগ, জেলাভিত্তিক শতকরা ১০ ভাগ, উপজাতীয়দের জন্য শতকরা ৫ ভাগ এবং প্রতিবন্ধিদের জন্য শতকরা ১ ভাগ, সর্বমোট ৫৬ ভাগ।
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও ও নাতি-নাতনি[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশদের জন্য প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান শতকরা ৩০ ভাগ কোটা নির্ধারণ করা হলেও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি কোনো আইনে সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় আজ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দাবিদার হিসেবে যারা চাকরি প্রার্থী তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী। এভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদধারীরা যদি সরকারের লোভনীয় চাকরি হাতিয়ে নেয়, তাতে যে শুধু মেধাহীনদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে তা নয় বরং সমগ্র মুক্তি সংগ্রামই কালিমায় আচ্ছাদিত হবে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরি হতে অবসরকালীন বিশেষ সুযোগ দেওয়ার কারণে বর্তমানে ভুয়া সনদ গ্রহণের যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তাতে দেখা যায়, সরকারের সচিব পদধারী কর্মকর্তাও পিছিয়ে নেই।
সরকারের বিভিন্ন ক্যাডারের ও বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকারী ব্যক্তি বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে কোনো ধরনের বিরূপ মন্তব্য না থাকা সাপেক্ষে ক্যাডার ও বিভাগের শীর্ষ পদে ও তদপরবর্তী পদসমূহে আসীন হয়ে থাকেন। সাধারণত দেখা যায়, একটি ব্যাচের মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকারী ব্যক্তি তার পূর্ববর্তী ব্যাচের কোনো কর্মকর্তা পদোন্নতির জন্য অবশিষ্ট না থাকলে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হন। পৃথিবীর সকল দেশে এ নীতিটি অনুসৃত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ২০০০ খ্রি. অবধি এ নীতিটি অনুসৃত হতে দেখা গেছে। বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও বিভাগে উচ্চতর পদে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় মেধার দিকটি উপেক্ষিত হয়েছে এবং প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্যরা পদোন্নতি প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হয়েছেন।
সরকার পরিচালনায় সরকারের বিভিন্ন শীর্ষ পদে আসীন কর্মকর্তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শীর্ষ পদে আসীন এ সকল কর্মকর্তা জ্যোষ্ঠ, যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী হলে তারা সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু গত এক যুগেরও অধিক সময় ধরে যেভাবে সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে জ্যোষ্ঠ, সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবীদের অতিক্রান্ত করে কনিষ্ঠ, অসৎ, অদক্ষ, অযোগ্য ও মেধাহীনদের বসানো হয়েছে তাতে জাতি হিসেবে যে আমরা মেধাশূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এ বিষয়ে বোধ করি দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক / সম্পাদনা: আশিক রহমান