শিক্ষার্থীর জীবন দক্ষতা ও নৈতিকতাও শেখানো জরুরি
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
আমাদের এখানে এমন অনেকেই আছেন যারা দানশীলতার ক্ষেত্রে একটা মাদ্রাসা করে দেন। মাদ্রাসা শিক্ষায় তো তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। মাদ্রায় কয়জন হুজুর লাগে আমাদের দেশে? বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসাগুলোতে তো কোনো রকম জীবন দক্ষতা শেখানো হয় না। আলিয়া মাদ্রাসা মোটামুটি একটা অবস্থায় পৌঁছে গেছে। কারণ আলিয়া মাদ্রাসা যেহেতু অনেক বেশি স্বচ্ছতার মধ্যে থাকতে হয়। জবাবদিহিতাও রয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসার একটা ঐতিহ্যও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের আলিয়া মাদ্রাসায় ঢাকা থেকে গিয়ে যারা পড়ালেখা করেছেন তাদের অনেকেই জগৎবিখ্যাত হয়েছেন। কারণ আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে ইংরেজি, বাংলা, গণিত, আরবি প্রায় সবই পড়ানো হয়। কিন্তু কওমী মাদ্রাসাগুলোতে সেসব পড়ানো হয় না। লাখ লাখ শিক্ষার্থী সেখানে পড়ালেখা করে তাদের ভবিষ্যৎ কী? একইভাবে প্রাইমারি স্কুলে আমাদের যে সন্তানেরা পড়ে তাদেরই বা ভবিষ্যৎ কী? ওদের তো আমরা সেই মুখস্ত করিয়ে ক্লাস ফাইভে একটা, এইটে একটা চাবুক মারছি। যারা পাস করছে তারা ঠিক আছে, আর ২১-২২ শতাংশ যে ঝড়ে পড়ছে তাদের কী হবে? তাদের নিয়ে কী আমরা ভাবি? ভাবি না।
মুখস্তবিদ্যা, কোচিং বাণিজ্যের প্রথা ভাঙার জন্য সরকারের অনেক করণীয় আছে। এই ভাঙার জন্য প্রথমে শিক্ষাখাতে সরকারকে বিনিয়োগের দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা থাকতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক চুক্তি থাকতে হবে। অর্থ্যাৎ আমাদের অভিভাবকেরা যেন এটা মনে করেন, সন্তানের সুশিক্ষাই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু একটা পরীক্ষার জন্য আমার সন্তানকে তৈরি করব না। এ বিষয়ে আমার একটা প্রস্তাব রয়েছে, যা অনেক শিক্ষকেরও প্রস্তাব। আমি মনে করি, পাবলিক পরীক্ষাগুলো তুলে দেওয়া উচিত। আমেরিকাতে যা হয়, দ্বাদশ শ্রেণির পর একটা হাইস্কুল সমাপ্তির পরীক্ষা হয়। বাকি সব শ্রেণিগত মূল্যায়ন। আমাদের এখানে ওয়ান থেকে টুতে উঠছি, টু থেকে থ্রিÑ অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের জন্য সন্তানদের ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকা উচিত নয়। আনন্দিত পাঠদান। তাহলে প্রতিযোগিতাটা হবে না। প্রতিযোগিতা হলোÑ কে কতটুকু জানতে পারছি, কে কয়টা বই পড়েছি। তাদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া উচিতÑ তাদের নেওয়া উচিত প্রকৃতিতে। পাঁচ রকমের গাছ দেখে একটা প্রবন্ধ লিখ। তাতে লেখা শিখবে, গাছও চিনবে, প্রকৃতিও দেখবে, জীবন দক্ষতাও উন্নত হবে। কোরিয়া এখন ওইদিকেই যাচ্ছে।
শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লে কি হবেÑ প্রত্যেকটি প্রাইমারি স্কুলকে সেন্টার অব অ্যাকসিলেন্স হিসেবে নিতে পারি। ৬৪ হাজার স্কুল আমার রয়েছে, সেখানে সবচেয়ে ভালো শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে পারি। শিক্ষক যদি ভালো বেতন পান, তার থাকা ফ্রি, নিজের বাগানটাগানও করতে পারবে। শিক্ষকতা পেশায় মেয়েদের আমি প্রাধান্য দিই। কারণ তার স্বামী তখন সেখানে যাবে। ঢাকার বাইরে মানুষ চলে যাবে। প্রাইমারি স্কুলগুলোকে কেন্দ্র করে গ্রামের মধ্যে একটা শিক্ষার সূচনা হয়ে যাবে। যখন পরিবারগুলো বুঝবে এখানে পরীক্ষাটা প্রধান নয়, শেখানোটাই প্রধান তখন মুখস্তবিদ্যা থেকে সরে আসব। সৃজনশীল বিষয়টাই গুরুত্ব পাবে। কোচিং বাণিজ্যও তখন বন্ধ হয়ে যাবে। যতদিন পাবলিক পরীক্ষা থাকবে, যতদিন শিশুদের উপর চাপ থাকবে ততদিন কোচিং বাণিজ্য থাকবে।
একটা উদাহরণ দিইÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। খুব প্রতিযোগিতামূলক। কতগুলো কোচিং বাণিজ্য চলছে। আমি দেখেছি বাস নিয়ে রংপুর, দিনাজপুুর থেকে। ওমুক কোচিংয়ের বাস, তমুক কোচিংয়ের বাস। আমরা যদি পদ্ধতি ঠিকমতো করে ফেলতে পারি তাহলে কোচিং বাণিজ্য থেকে শিশুদের দূরে রাখতে পারব। এজন্য বলছি, এসএসসিরও দরকার নেই। এসএসসিটাও ভেতর থেকে হোক না কেন? সাতটা শিক্ষাবোর্ড রয়েছে, বোর্ডগুলো আলাদা করে নিতে পারে।
এমনকি আমি করি, এসএসসি পর্যন্ত প্রত্যেক জেলাতেই একটা শিক্ষাবোর্ড হতে পারে। নিজেদের মতো করে করুক না চল্লিশ-পঞ্চাশ স্কুল নিয়ে একটা পরীক্ষা হবে। সব পরীক্ষা সমান হতে হবে তা তো নয়। কারণ ঢাকায় যে পড়ালেখাটা হচ্ছে, গ্রামে তো সেই পড়াশোনাটা হচ্ছে না। যদি শিক্ষার মানটা উন্নত করতে থাকি ক্রমাগত, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তা চলে যাবে। আর পরীক্ষার আধিক্য যখন চলে যাবে তখন শ্রেণিকক্ষের পরীক্ষাটাই গুরুত্বপূর্ণ উঠবে। তখন দেখা যাবে, সপ্তাহের প্রতিদিনই কিছু না কিছু পরীক্ষা হচ্ছে। হয়তো একটা রচনা লিখতে দিয়েছে, তার উপর মূল্যায়ন হচ্ছে। তখন আর পরীক্ষা ভীতিটা থাকবে না। একজন একটি গল্প লিখেছে, গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ওখানে আমি নম্বর দিয়েছি। একজন গান গাইতে পারে, তাকে পাঁচজনের মধ্যে বসিয়ে দিলাম। তুমি গান গাও, গানের অর্থ করো। গানের মূল্যটা বোঝাও আমাকে। এভাবে যদি করে যায় তাহলে সে গানটা জানল, গানের ইতিহাস জানল, গানের সংস্কৃতিটাও জানল। একটা নম্বরও পেল। একজন ভালো ক্রিকেট খেলে, তাকে আমি বললাম, তুমি ভালো ক্রিকেট খেলো তাহলে দশ নম্বর পাবা। ক্রিকেটের উপর রচনা লিখবে, ক্রিকেটের উপর লেখা তিনটি বই নিয়ে আলোচনা করবে, তার উপর তোমাকে আরও পাঁচ নম্বর দিব। তাহলে সে পনের নম্বর পেল তার খেলাধুলা সংক্রান্ত বিষয়ে। অর্থ্যাৎ সে লেখাও শিখে ফেলেছে। বই পড়াও শিখে ফেলেছে, যেটা আমি শেখাতে পারছি না।
এই ছেলে যখন বড় হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলবে, সুন্দর ভাষায় কথা বলা দেখে সকলে অবাক হবে। তার বই পড়ার ক্ষমতা দেখে অবাক হবে। যে যখন বই পড়া শিখেছে তখন সে বসে থাকবে না, ফিজিক্স পড়বে, কেমিস্ট্রি পড়বে, ডাক্তারিও পড়বে। আমি এটাই চাচ্ছি। নয়মাস পড়ালেখা হবে, বাকি তিনমাস হবে অন্য কাজগুলো। স্পোর্স ক্যাপ হবে, স্কাউট ক্যাম্প হবে, রিডিং ক্যাম্প হবে, নাটক, অভিনয়, আবৃত্তি হবে। একই সঙ্গে জীবন দক্ষতা ও নৈতিকতাও শেখানো হবে। প্রত্যেক স্কুলে অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাজে লাগানো যায়। কোনো একজন পাঁচটা স্কুলের দায়িত্ব দিলাম, বললাম, এই পাঁচটা স্কুলের শিশুদের আপনি নিয়মানুবর্তিতা শেখান। বিনিময়ে তাকে একটা সম্মানি তাকে আমি দিলাম। কিভাবে গাছে উঠতে হবে, কিভাবে সাতার কাটতে হবে, কিভাবে রাস্তা পার হতে হবে, জীবন দক্ষতা শেখাতে পারলে তারা শিশুরা সেভাবে গড়ে উঠবে। দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠবে। দেখা যায়, নদীতে নেমে মৃত্যুর সংবাদ পাই। সাতার জানে না। একটি নদীমাতৃতক দেশে একজন সাতার জানবে না কেন? এটা কিভাবে হয়।
পরিচিতি: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মতামতটি লিখেছেন আশিক রহমান