সুুশীল সমাজ আগের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে
আফসান চৌধুরী
সুশীল সমাজ হচ্ছেÑ সরকারের বাইরে যে শক্তি থাকে, যেখানে মানুষ থাকে, জনগণ থাকে এবং কিছুটা হলেও যারা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকেন না, তারাই সুশীল সমাজ বলে পরিচিত। রাজনৈতিকভাবে সুশীল সমাজ যে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারে সেটা ঠিক নয়। তবে তারা রাজনীতিতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশের সরকারের যে বিশাল পরিসর রয়েছে, সেখানে সুশীল সমাজের ভূমিকা রাখার জায়গাটা খুবই সীমিত, রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও সীমিত। সুশীল সমাজ এখন প্রায় দলীয়করণ হয়ে গেছে। সুশীল সমাজের অনেকেই এখন কোনো না কোনোভাবে একটি দলের পক্ষাবলম্বন করে থাকেন। সুশীল সমাজ যে এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তা দৃশ্যমান নয়। সুশীল সমাজকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেখা যায় না বললেই চলে।
দেশের সুশীল সমাজ আগের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার বদলে যারা টকশো করেন, তাদের অবস্থান শক্তিশালী। টকশো এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশের রাজনীতির বাইরে থাকা মানুষের বক্তব্য যদি রাজনৈতিক কেন্দ্রিকও হয়, তবে তা টকশোর মাধ্যমেই আসছে। এখনকার যে সুশীল সমাজ, এ সুশীল সমাজ গণমাধ্যম কেন্দ্রিকই বেশি। তা এখন অনেকটাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর নির্ভরশীল।
বামপন্থি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যারা জড়িত তারা এখন আগের মতো শক্তিশালী নয়। তাদের মধ্যে আনু মুহাম্মদ-এর তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি অনেক শক্তিশালী ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তাদের কিছু সমস্যাও রয়েছে। তার মধ্যে জনসম্পৃক্ততা। সাধারণ মানুষকে তাদের কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারছে না বললেই চলে। কারণ, সাধারণ মানুষ শুধু রুটি-রুজি নিয়ে এতবেশি চিন্তা-ভাবনা করে, যার ফলে পরিবেশ ও তার দীর্ঘকালীন যে ক্ষতির কারণ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময়ই পায় না। সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারছে না বললেই চলে। সমাজের যেকোনো আন্দোলন এখন সুশীল সমাজের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
পরিচিতি: গবেষক ও গবেষক
মতামত গ্রহণ: শরিফুল ইসলাম / সম্পাদনা: আশিক রহমানএখন শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ
সুভাষ সিংহ রায়
কবিগুরু এই উচ্চারণ প্রকৃতার্থে পূর্ণাঙ্গতা পায় বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে। এ কারণে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় ‘ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য ন্যাশন’। আর শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আদর্শের সফল বাস্তবায়ক। এখানে শেখ হাসিনা অনন্য ও অসাধারণ। মাত্র কয়েকমাস আগে হাফিংটন পোস্টের ব্লগে শেখ হাসিনা লিখেছেন, জনগণকে রক্ষায় কারও দিকে তাকিয়ে নেই বাংলাদেশ’। একমাত্র এবং একমাত্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব সভায় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ৬৮তম জন্মদিনে লিখেছিলেন, ‘বহু জন্মদিনে গাঁথা আমার জীবনে/দেখিলাম আপনারে বিচিত্র রূপের সমাবেশ।’ ২০১৫ সালেই ইউনিসেফের মহাসচিব ইরিনা বোকাভা শেখ হাসিনার হাতে ‘পিস ট্রি’ পদক তুলে দিয়েছিলেন। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিসেফের মহাসচিবের বক্তব্যের সারার্থ। ‘এই সাহসী নারী আলোকবর্তিকা হিসেবে সারা পৃথিবীতে পথ দেখাচ্ছেন।’ সত্যিইতো শেখ হাসিনার জীবন কর্মবহুল ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখন এটা শুধু একটি নামই নয়, এটা একটি প্রতিষ্ঠান। ডড়ৎশ রং ড়িৎংযরঢ় যার জীবনের মূলমন্ত্র। কর্ম-জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত এক অসাধারণ জীবন তার। শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির ৎধষষরহম ঢ়ড়রহঃ, পবসবহঃরহম নড়হফ। জননেত্রী শেখ হাসিনা এদেশের জনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের একটি রূপক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্যাটার্নেও সাদৃশ্য খুব বেশি। ত্যাগ, প্রজ্ঞা, ঐক্যচেষ্টা, সাংগাঠনিক শৃঙ্খলা, ভাবাদর্শেও যুগোপযোগী সমন্বয় ইত্যাদি সবকিছুর দিক দিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পিতাপুত্রীর মধ্যে অদ্ভুত মিল। পার্থক্য শুধু প্রেক্ষাপটগত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেও বিকাশ ঘটেছিল বিজাতীয় পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, আর শেখ হাসিনাকে লড়তে হয়েছে ১৯৭৫-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাসি প্রতিবিপ্লবের বেনিফিসিয়ারিদের বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৫৩ সালের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাউন্সিল সম্মেলন থেকেই অসাম্প্রদায়িক নীতির পক্ষে অবস্থান নেয়। এই কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব যে রিপোর্ট উপস্থাপন করেন তাতে তিনি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে সম্প্রদায়গত বিভেদ দূর হওয়ার ইঙ্গিত দেন। ১৯৫৫ সালেই এই সংগঠনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অসাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়।
আমরা জানি, সুখে থাকবার, স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করার আকর্ষণ মানুষের জন্য খুবই স্বাভাবিক। সাধারণের জন্য এটাই কাক্সিক্ষত জীবনযাপন। ত্যাগের কথা শাস্ত্রে আছে, মনীষীদের জীবনগ্রন্থে আছে, চলমান জীবনাচরণে থাকাটা অস্বাভাবিক। শেখ হাসিনার চরম শত্রুও বলবেন শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আর যারা শেখ হাসিনাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখার চেষ্টা করেন তারা খুবই ভুল করেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ শেখ হাসিনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি ছিলেন। ১৯৮৮ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণকে লেখা শেখ হাসিনার অসাধারণ চিঠির কথা সামাজিক গণমাধ্যমের কারণে অনেকেরই নজরে এসেছে। ছোট্ট চিঠিটার হুবহু পাঠকদের জন্যে উৎকলন করছি।
বন্ধুবরেষু গুণ, আপনার অনুরোধে কিছু ছবি পাঠালাম। তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। ‘ত্রাণ বিতরণ করছি’ এ ধরনের কোনো ছবি ছাপাবেন না। মানুষের দুর্দশার ছবি যত পারেন ছাপান। আমার ধারণা এ ধরনের অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে দেখে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? একশ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে? যা কিছু আছে সকলে মিলে ভাগ করে ভোগ করলে একের কাছে অপরের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না। ওদেরই সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে আবার ওদেরই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সাহায্য দানের নামে হাতে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ অথবা প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস আমি মানসিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিবেকে বাধে। তবুও অনেক সময় পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও করি। বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে অনেক সময় সমাজ রক্ষার তাগিদে, সঙ্গীদের অনুরোধ বা অপরের মান রক্ষার জন্য এ ধরনের কাজ বা ছবি তুলতে হয় বৈকি।
তবে যে যাই দান করুক না কেন, বিলি করুক না কেন, এটা তো ওই গরিব মানুষগুলোর অধিকার, তাদেরই প্রাপ্য। ক্ষমতার দাপটে কেড়ে নেওয়া ওদেরই সম্পদ অথবা ওদের পেটের ক্ষুধা দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ভিক্ষে এনে এদের দান করা। এখানে ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার সুযোগ কোথায়? এই ‘ক্রেডিট’ নিতে যাওয়াটা কি দুর্বলতা নয়? আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? কতকাল আর বিবেককে ফাঁকি দিবে? এই গরিব মানুষগুলোর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে আবার এদেরই হাতে ভিক্ষে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ইমেজ তৈরির পদ্ধতি আমি পছন্দ করি না।
আমি মনে করি, যা দান করব তা নীরবে করব, গোপনে করব। কারণ এটা লজ্জার ব্যাপার, গর্ব করার ব্যাপার মোটেই নয়। গর্ব করার মতো কাজ হতো যদি এই সমাজটাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়া যেত। গর্ব করার মতো হতো যদি একখানা কাঙালের হাতও সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে না দিত। ফুটপাথে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ভিক্ষের হাত না বাড়াতে সেটাই গর্ব করার মতো হতো। যে স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন, সেদিন কবে আসবে? আমার অনুরোধ আপনার কাছে, সেই ছবি ছাপাবেন না যে ছবি হাত বাড়িয়েছে সাহায্য চেয়ে, আর সেই হাতে কিছু তুলে দিচ্ছি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। অনেকেই তুলে থাকেন। আমার বড় অপরাধী মনে হয় নিজেকে। লজ্জা হয় গরিব মানুষদের কাছে মুখ দেখাতে। আমরা সমাজে বাস করি। দুবেলা পেট পুরে খেতে পারি।
ভালোভাবে বাঁচতে পারি। কিন্তু ওরা কি পাচ্ছে? ওদের নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা কেন? ওরা বরদাশত করবে না, একদিন জেগে উঠবেই সেদিন কেউ রেহাই পাবে না। আমার অনুরোধ আশা করি রাখবেন।
শুভেচ্ছান্তে
শেখ হাসিনা
৯.১০.৮৮’
১৯৯৮ সালের এদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো এই বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করেছিল। বিবিসির মতো সংবাদ মাধ্যমগুলো অন্তত ১০ লাখ লোক মারা যাবে বলে আশঙ্কা করেছিল। এই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন। বন্যার পর ক্ষুদে কৃষক, বর্গাচাষী, ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য নয়া নীতিমালা তৈরি, আদেশ প্রদান, ব্যাংকের শাখায় কারা ঋণ পাচ্ছে তার তালিকা করা। এতসব যুগান্তকারী কাজকর্ম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। এগুলোকে আমরা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত না বলে আর কি বলব। তার কর্মনিষ্ঠার কারণে একজন মানুষও না খেয়ে মরেনি। আশ্চর্যজনকভাবে বন্যার পরের বছর বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বেড়ে ছিল।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান