চাই উন্নতমানের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা
ডা. জাকির হোসেন
মানুষের মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো চাহিদাগুলার পরই শিক্ষা ও চিকিৎসা। সময়ের সঙ্গে মানুষের প্রতিটি চাহিদার মধ্যে নানারকম পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মানুষ সভ্য হওয়ার যুগে এ সব মৌলিক চাহিদা শুধু চাহিদার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো শুধুমাত্র একজন মানুষের চাহিদার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এসব মৌলিক চাহিদা প্রতিটি সভ্য দেশে মানুষের অধিকারও বটে।
বিশ্বের প্রতিটি সভ্য রাষ্ট্রই তার জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে তার নাগরিকদের ন্যূনতম চাহিদার যোগান দিতে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াকে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে ধীরে ধীরে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে। জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকের স্বাস্থ্যের মানউন্নয়ন একান্ত জরুরি। কারণ স্বাস্থ্য মানবউন্নয়ন পরিমাপের একটি বিশ্বজনীন সূচক হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সামনের দিকে একধাপ এগিয়ে নিতেই আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন আইপিজিএমআর বা পিজি হাসপাতালকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। দেশের সকল মানুষ, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যাতে উপকৃত হয় সে লক্ষ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি শুরুর দিকে তার একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করে অধিকসংখ্যক দক্ষ চিকিৎসক তৈরি করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় যুগান্তকারী একটি পরিবর্তন ঘটানো।
এই লক্ষ্যে জরাজীর্ণ পোস্ট গ্রাজ্যুয়েট মেডিকেল শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে, বেশিরভাগ উন্নত দেশে প্রচলিত রেসিডেন্সি প্রোগ্রামকে বাংলাদেশের মতো একটি সীমিত সম্পদের দেশে উপযোগী করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজ্যুয়েট রেসিডেন্সি কোর্স চালু করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সময়ের সার্জারি অনুষদের ডীন ডা. প্রফেসর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সাবেক ভিসি ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত এবং তাদের সমমনা কিছু সংখ্যক স্বনামধন্য চিকিৎসকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ছিল পোস্ট গ্রাজ্যুয়েট মেডিকেল কোর্স রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম। অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য। যার ফলে তিনি চিকিৎসকদের বিভিন্ন ধরনের গ্রুপিং, অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক চাপকে উপেক্ষা করে একাডেমিক কার্যক্রমকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্ট করেছেন।
তার অদম্য চেষ্টায় তিনি অনেক ক্ষেত্রে বেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। রেসিডেন্সি প্রোগ্রামের অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত সার্জারি অনুষদের সাবেক ডীন ডা. প্রফেসর মো. সাইফুল ইসলাম অনেকগুলো নিয়ম-নীতি তৈরি করেছিলেন এবং সেগুলোকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইন হিসেবে পাস করাতে চেয়েছিলেন যাতে করে কেউ ইচ্ছে করলেই এত সুন্দর একটি পোস্ট গ্রাজ্যুয়েট মেডিকেল কোর্সের কোনো রকম ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যাদের মাধ্যমে রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম ভূমিষ্ট হয়ে আলোর মুখ দেখা শুরু করেছিল, তাদের কোনো অবজারভেশনকেই তাদের তৈরি বেশির ভাগ নিয়ম-নীতিকে আইনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। যার খেসারত গুনতে হবে এ সময়ের রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের, অনেকটা হোঁচট খাবে সরকারের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি। আবারও পোস্ট গ্রাজ্যুয়েট মেডিকেল কোর্স থেকে ঝরে পড়বে হাজার হাজার মেডিকেল গ্রাজ্যুয়েট, প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসাসেবা থেকে। অতি সম্প্রতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মানের উপর র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। এই র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ৮৮তম অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত রয়েছে ১১২ এবং পাকিস্তান রয়েছে ১২২তম অবস্থানে।
বাঙালি জাতির যেমন অনেক সুনাম রয়েছে, দুর্নাম আছে। আমাদের মধ্যে অন্য দেশের আচার-আচরণ, সংস্কৃতি নকল করার প্রবণতা খুব বেশি। আমরা কথায় কথায় ভারতের চিকিৎসাব্যবস্থার গুণগান গেয়ে থাকি। অবশ্যই তাদের চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের থেকে অনেক উন্নত, যদিও সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সূচকে আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে ভারত। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো হওয়ার অন্যতম কারণ হলোÑ তাদের চিকিৎসকেরা প্রজ্ঞার সঙ্গে একজন চিকিৎসককে হাতে কলমে শিখিয়ে চিকিৎসক করে তোলে। যা আমাদের এখানে একেবারেই চোখে পড়ে না। আমরা ভারতের চলচ্চিত্র, গান, এমনকি বিজ্ঞাপন পর্যন্ত নকল প্রবণতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু ভারতীয়রা জাতীয় জীবনে তারা যেভাবে মেধাবীদের মূল্যায়ন করে সেটা কী আমাদের এখানে হচ্ছে?
খ্যাতিমান বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম রাজনীতিবিদ না হওয়া সত্ত্বেও তার মেধাকে সম্মান দেখানোর জন্য সেদেশের জনগণ ও সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ আসনে অধীষ্ঠিত করেছে। আমাদের দেশে এ ধরনের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারিনি আমরা। আজকে যেসকল প্রাণপুরুষদের হাত ধরে এদেশে রেসিডেন্সি পোস্ট গ্রাজ্যুয়েট মেডিকেল কোর্স চালু হয়েছিল, ব্যক্তিস্বার্থে তাদের দূরে সরিয়ে না রেখে জাতীয় স্বার্থে তাদের মেধাকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা যেত। কারণ মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে পারলেই একজন সুচিকিৎসক তৈরি হবে, যাদের হাতে এদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা পাবে।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান