সাইকেলে কিসের ভয়?
কল্লোল মোস্তফা : যে কারণে নাটকে, বাহাসে, খোলা চিঠিতে, যুক্তি-তর্কে ভয়…। সরকার জানে রামপাল বিদুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রবল জনমত গড়ে উঠেছে। সে জনমত যেন সহজে বড় আকারের মাস মোবিলাইজেশানে পরিণত হতে না পারে, সে কারণেই সাইকেল মিছিলের মতো প্রোগ্রামগুলোতে হামলা-জলকামান-গ্রেফতার-নির্যাতন চালানো হয়…। যেন শুরুতেই উৎসাহী তরুণ-তরুণীদের দমিয়ে দেওয়া যায়। তাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করা যায়Ñ এই আন্দোলনে গেলে তোমাদের ভুগতে হবে, ফলে যা করেছ করেছ, আর করবে না, আর বেশি বাড়াবাড়ি করবে না… এ রকম একটা বার্তা দেওয়া আর কি।
এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেইÑ ছাত্রলীগ স্রেফ নিজেদের বুদ্ধি ও পরিকল্পনায় আগের দিন রাত থেকে হলগুলোতে ভয়ভীতি দেখিয়ে ফাস্ট ইয়ারের শিক্ষার্থীদের শহীদ মিনার দখল করে সাইকেল মিছিলে বাধা দেওয়ার কাজে নিয়ে এসেছে। জলকামানের গাড়িগুলোও ব্যাকাপ হিসেবে আপনা-আপনি দাঁড়িয়ে ছিল না…। এসবই করা হয়েছে উপর মহলের নির্দেশেÑ স্ট্র্যাটেজিক বিবেচনা থেকে।
সরকার জানে, সাইকেল মিছিলের মতো শান্তিপূর্ণ একটি প্রোগ্রামে বাধা দিলে নিন্দা হবে, সমালোচনা হবে। কিন্তু নিন্দা সহ্য করে হলেও ব্যাপক মাস মোবিলাইজেশানের সম্ভাবনা যত ভাবে সম্ভব নষ্ট করার চেষ্টা করতে হবে, তাকে আর নিন্দা হলেই বা কি। যাদের ভাবমূর্তি বা মর্যাদা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই, তাদের সেটা হারানোরও ভয় নেই। তাছাড়া সরকার এ ব্যাপারে ভারতের কাছে দায়বদ্ধ। ভারতীয় এনটিপিসির ভারতের বাইরে কোনো প্রকল্প নেই। শ্রীলংকায় ছিল সেটাও বাতিল হয়ে গেছে।
এখন রামপালেরটাও যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে দেশের বাইরে এক্সপানশনের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। কিন্তু সরকার অন্যায়ভাবে যা চায় তা কি আর হয়। আমি খেয়াল করে চেষ্টা করেছি, বিশেষ করে রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে যেসব মানুষ রামপাল আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন কিংবা নিজেরা হাতে নিয়েছেন, সরকারকর্তৃক সে সবে বাধা দেওয়ার পর তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কিনা। পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, তবে সেটা আন্দোলনের পক্ষে, সুন্দরবনের পক্ষে, রামপাল বিদুৎকেন্দ্রের বিপক্ষে।
খোলা চিঠির মিছিলে এসে যে সংস্কৃতিকর্মী কিংবা শিক্ষার্থী টিয়ারগ্যাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন কিংবা সুন্দরবনের পক্ষে নাটক/বাহাস করতে গিয়ে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন, তারা সকলেই আন্দোলনে আরও গভীরভাবে যুক্ত হয়েছেন। আন্দোলনে তাদের রীতিমতো ওনারশিপ তৈরি হয়েছে। আমি নিশ্চিত, সাইক্লিষ্ট বন্ধুদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। ঘটবে না বলে অলরেডি ঘটছে বলা যেতে পারে, কারণ ছাত্রলীগের মাস্তানদের দ্বারা ঘেরাও হওয়ার পরও তারা ভয় পাননি বা দমে যাননি। রীতিমতো লড়াই করে ঘেরাও ভেঙে সাইকেল মিছিল করেছেন, পুলিশের জলকামানের রঙিন পানির তীব্র স্রোতেও অবিচল থেকেছেন তারা…।
শুধু তাই না, ছাত্রলীগ যাদেরকে হল থেকে জোর করে মানববন্ধনে নিয়ে এসেছিল, রামপালের মতো একটা জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্পের পক্ষে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার যে গ্লানি তাদের কয়েকজনের মধ্যে দেখেছি। তাতে তাদেরও একটা অংশ নানানভাবে এই আন্দোলনে যুক্ত হবেন বলে আমার ধারণা…। আন্দোলন যখন সারাদেশে ছড়িয়ে যায়, যখন মানুষের নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে পরিণত হয়, তখন ক্ষমতাসীনদের পক্ষে বাধা দিয়ে কুলানো সম্ভব নয়, যেমনÑ সাইকেল মিছিল প্রথমে ঢাকায় ঘোষিত হলেও ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের তরুণ-তরুণীদের উদ্যোগে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এভাবেই সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বড় হতে হতে আজকের অবস্থায় এসেছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের আন্দোলন যখন দেশের ভিতরে ও বাইরে প্রবল জনমত গড়ে উঠেছে, তরুণ-তরুণীরা স্বতস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে নানান কর্মসূচি নিচ্ছেনÑ নিশ্চয়ই সাইকেল মিছিলের মতো আরও অনেক কর্মসূচি আসবে সামনে।
সবশেষে, ভারত ও ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির উদ্দেশ্যে একটা কথা (সরকারকে বলে লাভ নেই, ভারত বা এনটিপিসি যতদিন চাইবে, সরকার তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে) কয়লাবিদ্যুতের কারণে নিজ দেশের ভিতরে এমনতেই আপনারা নানাভাবে নিন্দিত। বাংলাদেশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গিয়ে সারা দুনিয়ায় যেভাবে আপনাদের দুর্নাম রটেছে, সুন্দরবনের কথা বাদ দিলাম, দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের ভালো চাইলে, আরও বড় ড্যামেজের হাত থেকে বাঁচতে চাইলে দ্রুত সুন্দরবনের কাছে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র করার এই পরিকল্পনাটা বাতিল করুন। আখেরে আপনাদের ভালো হবে।
লেখক: গবেষক ও প্রকৌশলী