সীমান্ত হত্যা কি চলতেই থাকবে?
ওয়াসিম ফারুক
ভারত আমাদের প্রতিবেশী, বন্ধুপ্র্রতিম দেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান চিরস্মরণীয়। কোনোভাবেই তাদের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। স্বাধীনতার পরও বিভিন্ন সময় তাদের আমরা পাশে পেয়েছি। এখনো তারা আমাদের পাশেই রয়েছেন। আমাদেরও চেষ্টার কমতি নেই তার বিনিময় দেওয়ার। সবসময়ই আমরা বন্ধুত্বের মর্যাদার রাখার চেষ্টা করেছি।
বন্ধুত্ব এক মধুর সম্পর্ক। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধার মাধ্যমে সেই বন্ধুত্ব অটুট থাকে। কিন্তু এক বন্ধুর বুলেটের আঘাতে যখন অপর বন্ধুর বুকের রক্ত ঝরে তখন সেই বন্ধুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বন্ধুত্বের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যা নিয়ে অনেক কথা হয়। দুই দেশের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে প্রায়ই মিটিং করেন, আশ্বাস দেন সীমান্তহত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার। কিন্তু বাস্তবে কি তার প্রতিফলন আমরা দেখি?
কিছুদিন আগে কুড়িগ্রাম ও ঝিনাইদহ সীমান্তে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী। গরু চোরাচালানের কারণেই নাকি সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা যাচ্ছে নাÑ এমনটি দীর্ঘদিন ধরেই আমরা শুনে আসছি। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এক ঘোষণার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। অবশ্য তার প্রমাণ এবারের কুরবানির ঈদে আমরা দেখেছি। ঢাকাসহ সারাদেশের হাটগুলো ছিল দেশীয় খামারিদের গরুতে ভরপুর। গরু চোরাচালানের জন্যই যে সীমান্তহত্যা হয় তা ভুল প্রমাণ করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর একটি প্রতিবেদন। ১ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে এই সংবাদ মাধ্যমটি একটি সংবাদ পরিবেশন করেছিল, যার শিরোনাম ছিল, ‘কমেছে গরু পাচার, বেড়েছে সীমান্তহত্যা’ সংবাদটিতে বলা হয়েছিল, বিএসএফকে দেওয়া ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের নির্দেশনার পর গত সাত মাসে বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ গরু চোরাচালান কমে গেছে। তবে এর বিপরীতে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি।
রাজনাথ সিংয়ের ঘোষণার পর ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে নিহত হয়েছে ২৪ বাংলাদেশি। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে সীমান্তে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিলেন ১০ বাংলাদেশি।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি ২০০০ থেকে ৩১ মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারীবাহিনীর হাতে জীবন দিতে হয়েছে ১০৮৪ জন বাংলাদেশিকে আর আহত হয়েছে ৯৮৭ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, গত তিন বছরে অর্থাৎ ২০১৩ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বেড়েছে। এই হত্যাকা-গুলো ঘটছে গোলাগুলি ও নির্যাতনের কারণে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা। এদের মধ্যে ১২ জনকে গুলি করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। বাকি একজনকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তা জানা যায়নি।
এরপর ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে। এর মধ্যে গুলি ও নির্যাতনে সমান সংখ্যক বাংলাদেশিকে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে হত্যা করা হয়েছে ৪২ জনকে, আহত হয়েছেন ৬৮ জন। এছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে। গত তিন বছরে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যায় ২০১৫ সাল শীর্ষে অবস্থান করছে।
২০১৬ জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই আট মাসে বিএসএফের হাতে খুন হতে হয়েছে ২৩ জন বাংলাদেশিকে আর আহত হয়েছে ২৫ জন। তবে যে চিত্রটি সবচেয়ে অবাক করার মতো তা হচ্ছে পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত। তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে মোট ১০২ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হলেও একই সময়ে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে ৪৬ জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত হয়। নিহত পাকিস্তানি নগারিকদের বড় একটি অংশ সামরিক এবং আধা-সামরিকবাহিনীর সদস্য। তবে বাংলাদেশের নিহত নাগরিকরা সবাই নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশ-ভারতসহ সারাবিশ্বকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল কিশোরী ফেলানী হত্যাকা-। ৭ জানুয়ারি ২০১১ কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি সীমান্তে ১৫ বছরের এক কিশোরী ফেলানী কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় জড়িয়ে পা ফসকে ঝুলে পড়েছিল সে। তখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করে আবেদন করছিল। তার এ মানবিক আবেদনে ইতিবাচক সাড়া না দিয়ে অমানবিকভাবে হত্যা করা হয়। কাঁটাতারে ঝুলে থাকে কিশোরী ফেলানী।
কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রচারিত হলে নিন্দার ঝড় উঠে। প্রতিবাদ করেন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বিবেকবান মানুষ। পরে ২০১১ সালেই বিএসএফ ও বিজিবি পাচারকারী অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি স্বাক্ষর করে। আমরা ভেবেছিলাম, বুলেটে আর বিদ্ধ হতে হবে না কোনো বাংলাদেশিকে, খালি হবে না আর কোনো মায়ের বুক। কিন্তু আমাদের সেই আশার গুড়েবালি হয়েছে।
গত কয়েকবছরে সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন সহস্রাধিক নিরস্ত্র মানুষ। এদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফের হাতে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবির গুলিতে কোনো ভারতীয় নাগরিকের প্রাণহানির খবর গত কয়েক বছরে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।
আমরা যতটুকু জানি, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবির হাতে যখনই কোনো অবৈধ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ে তাদের নিরাপদে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ)-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। আর বিএসএফ নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে নিরস্ত্র নিরীহ বাংলাদেশিদের। এমনটি আর কত চলবে?
কেউ যদি আইন অমান্য করে অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিতে চায়, তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক। কিন্তু গুলি করে হত্যা করা কোনো সমস্যারই সমাধান হতে পারে না। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চিরদিন বজায় থাকবে এটা আমাদের সবারই প্রত্যাশা, তবে এ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে এক্ষুণি। আর যে কারণে সীমান্তে হত্যা সংঘটিত হচ্ছে তা দুই দেশের সরকারকে খুঁজে বের করে এর আশু সমাধান করাটাই জরুরি।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান