এখন শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মানুষের উপর ঋণের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরিব আরও গরিব হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশে আসার পর থেকে সব সময় চেষ্টা করেছেন কিভাবে মানুষের কষ্ট লাঘব করা যায়। সেটা তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থা হোক কিংবা ক্ষমতার বাইরে থেকে হোক। দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সব সময় তার চেষ্টা ছিল কীভাবে দেশের জনগণের ঋণের বোঝা কমানো যায়। ১৯৯৭ সালে মাইক্রোক্রেডিট সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় তিনি হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় হোয়াইট হাউসের ওই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ ওই সময় পর্যন্ত যে ঋণ নিয়েছিল তা যেন মওকুফ করে দেন। সেই সময় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন মোট ঋণের একাংশ মওকুফ করে দেন। সেই মওকুফ করা অর্থ বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণসহ বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণে ব্যবহারের সিদ্বান্ত নেওয়া হয়েছিল।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, জাতির ক্রাইসিসের সময় শেখ হাসিনাকে ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায় না। আব্দুল গাফফার চৌধুরী ১৯৯৩ সালে এক লেখায় উল্লেখ করছিলেন এভাবেÑ ‘সপ্তাহ দুই ঢাকাতেই ছিলাম। দেখা হতেই শওকত ভাই (শওকত ওসমান) আমার হাত ধরে বলেছিলেন, গাফ্্্্্্্্্্্্্ফার, দোহাই তোমার, হাসিনার সমালোচনা করো না। দীর্ঘকাল ধরেই তো চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি, এত জ্ঞানী-গুণী, ডান বামের বড় বড় নেতা। মুখে হাসিনার এত নিন্দা সমালোচনা। কিন্তু ক্রাইসিসের সময় হাসিনা ছাড়া কাউকে দেখি না।’ মাত্র কয়েকদিন আগে বিখ্যাত পত্রিকা ‘গার্ডিয়ান’ এর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আই ডু পলিটিক্্্স ফর দ্য পিপল’ (আমি জনগণের জন্যে রাজনীতি করি)। সারা পৃথিবীর পরিবিশ কর্মীদের কাছে একজন আলোকবর্তিকা। যে কারণে ২০১৫ সালের ৬৮তম জন্মদিনের কয়েকদিন আগে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্ব্বোচ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ান অফ দ্য আর্থ ’ অর্জন করেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৯৭ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মওকুফ করা অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্রের সংরক্ষণে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনার প্রতিটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সুদূর প্রসারী চিন্তা-ভাবনা থাকে।
শেখ হাসিনাকে অনেকে বলে থাকেন ‘ভীষণ একগুয়ে’ স্বভাবের। তা ঠিক। দৃঢ়তা ও জেদ তাকে মহান করেছে। শেখ হাসিনা ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের তদন্তের জন্য ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। স্যার টমাস্ উইলিয়ামস্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্ কিউসি (এমপি), শ্যেন ম্যাকব্রাইড, জেফরি থমাস্, কিউসি প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে এই আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার আগেই নিরবিছিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। জানি না, কোন এক অজানা কারণে অনেক কিছু অনেক কিছুর সঙ্গে মিলে যায়। কোনো এক জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘সত্তা আমার, জানি না সে কোথা থেকে/হলো উত্থিত নিত্যধাবিত স্রোতে’। ১৬/৪/৯২ তারিখে গোলাম আজম ও গণআদালত প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ দিয়েছিলেন তা আজকের প্রজন্মের ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। সেই ভাষণের কিছুটা অংশ এই পরিসরে উৎকলন করব। ‘মাননীয় স্পিকার,/অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি: গত কয়েক দিন ধরে আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, আজ একজন যুদ্ধাপরাধী, স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যার বিচার হয়েছে; সে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারিয়েছে, রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে, ভোটার তালিকায় যার নাম নেই ভোট দেবার, ভোটে অংশ গ্রহণ করবার, সব অধিকার হারিয়েছে। রাজনীতি করার যে অধিকার হারিয়েছিল আজ স্বাধীনতার এত বছর পর তাকে নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে এবং সে যুদ্ধাপরাধী কিনা, তার পক্ষে কেউ কেউ কিতাবের পর কিতাব তুলে নিয়ে এমনভাবে ওকালতিতে নেমেছেন এর প্রতিবাদ বা নিন্দা করবার ভাষা আমার জানা নেই। শুধু সুকান্তের ভাষায় বলতে হয়, ‘অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি।’ আমরা বিস্মিত, অবাক, মর্মাহত এবং ব্যথিত হয়েছি। শুধু মনে হয়, আমরা কি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বাস করছি, নাকি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পরেও বন্ধনীতে কোনো নাম অলিখিতভাবে লিখিত হয়েছে আমরা সেই দেশেই বাস করছিÑ সে প্রশ্নটাও আজ বারবার মনে জাগছে।
মাননীয় স্পিকার, আপনি জানেন, দেশবাসী নিশ্চয়ই তা জানে। সেই সময় প্রায় চার লাখ বাঙালি পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় ছিল। তাদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার জন্য রাস্তায় নেমেছিল, বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিল। আমাদের কাছে এসেও তাদের আত্মীয়-স্বজন অনেকে কান্নাকাটি করেছেন। এই রকম একটা অবস্থায় সেইসব বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার জন্যই এই ঈষবসবহপু (ক্ষমা) দেওয়া হয়েছিল। এদেশে ফেরত আসতে পেরেছিলেন আজকে যিনি জেনারেল লতিফ এবং জেনারেল মাহমুদুল হাসান, জেনারেল সালামসহ অনেকেই। আজকে এখানে মন্ত্রীদের সারিতে বসে আছেন মজিদ-উল-হক সাহেব, মোস্তাফিজুর রহমান সাহেব, সেদিন সেই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছিল বলেই তারা এ দেশে ফেরত আসতে পেরেছিলেন। এবং আমি মনে করি, তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর সেই প্রচেষ্টার কথা আজ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবেন এবং বলবেন ঈষবসবহপু (ক্ষমা) দিয়ে বঙ্গবন্ধু ভুল করেননি। কিন্তু ঈষবসবহপু (ক্ষমা) দিলেই যে বিচার করা যাবে না, এমন তো কথা নেই। এদের বিচার করার জন্য তো বঙ্গবন্ধু এ্যাক্ট করে রেখেছিলেন, সেটা হলো অপঃ ঢওঢ ড়ভ ১৯৭১ (আন্তর্জাতিক ক্রাইম এ্যাক্ট) এবং সংবিধানের ৪৭ (৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বিধান রয়েছে যে, এদের বিচার করা যাবে। সাধারণ ক্ষমা করার ব্যাপারে আরও কিছু কারণ ছিল। মাননীয় স্পিকার, আপনি সে সব কথা জানেন। কেননা আপনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই দেশে যে মুক্তিযুদ্ধ হয় সেটা গেরিলা যুদ্ধ ছিল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাড়ির একজনকে কোনো একটা পদে রেখে সেই বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এই ধরনের যে সমস্ত কেস ছিল, যারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে, তাদেরকেই বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু যারা সত্যিকার যুদ্ধাপরাধী, বিশেষ করে যারা গণহত্যা চালিয়েছে, যারা লুটপাট করেছে, যারা নারী ধর্ষণ করেছে, যারা অগ্নিসংযোগ করেছে তাদেরকে কিন্তু ক্ষমা করা হয়নি। এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যÑ
* ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন জারি করা হয় চ.ঙ. ঘড়. ঠওওও ড়ভ ১৯৭২.
* ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্ব স্ব জেলা কোর্টে অধ্যাপক গোলাম আজম গংদের হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি হয়েছিল।
* ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন জারি করা হয়। চ.ঙ. ঘড়. ১৪৯ ঠওওও ড়ভ ১৯৭২.
*১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গোলাম আজম গংদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
* ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রহিত করা হয় এবং
* ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দালালদের ভোটাধিকার ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল করা হয়।
* ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের আমি আগেই বলেছি, যারা গণহত্যা করেছে, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করেছে সেই সব অপরাধীদের ক্ষমা করা হয়নি। এই আইনগুলো বঙ্গবন্ধু করেছিলেন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান