একাল-সেকাল, রাজনীতির দুইকাল
আমরা আসলে কোন কালের রাজনীতি করি নিজেরাই বোধ হয় জানি না। রায়ের বাজার বাড়ি হওয়ায় আবাহনী খেলার মাঠ ছিল আমাদের খুবই প্রিয় একটি স্থান, সারাদিন খেলাধুলা, আড্ডা মেরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশে লেকে গোসল করে বাড়ি ফিরতাম। প্রায় প্রতিদিনই এটি করতাম। একরকম রুটিন হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনের এই যাওয়া-আসার ফলে সৌভাগ্যবশত মাঝেমধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হতো। মানুষটিকে যতই দেখতাম ততই মুগ্ধ হতাম।
শিশুর প্রতি গভীর ভালোবাসা, কর্মীদের প্রতি কর্তব্য পালনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই সচেতন, আন্তরিক। নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতেন, কিভাবে কাছে টানতেন তার অনেক কিছুই দেখেছি। উদার, আন্তরিক, অসম্ভব দরদী বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব কতটা আকর্ষণীয় ছিল তা তো আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখতেই পাই। তার ব্যক্তিত্ব আমাকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল। কখন যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রচ- টান অনুভব করা শুরু করেছি তার টেরটিও পাইনি। সবসময়ই তাকে অনুসরণ করতাম। সুযোগ হলেই দূর থেকে হলেও শুনতাম তার বক্তব্য, মানুষের সঙ্গে যখন কথা বলতেন তখন খুব আপন করে নিতেন। দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন বাঙালির প্রিয় মুজিব। অথচ এই মানুষটিকেই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকেরা।
সময়টি ছিল আমাদের জন্য বড় দুঃসময়। বঙ্গবন্ধু নেই, তাকে হত্যা করা হয়েছেÑ এমন সংবাদে ভীষণ কষ্ট পাই। সবকিছুই যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। জীবন তো আর থেমে থাকে না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খেলার মাঠ, লেকপাড়ে যাওয়া একরকম বন্ধ করে দিই। যার জন্য যাওয়া, যাকে দেখার জন্য বারবার আকুল থাকতাম, তিনি নেইÑ সেখানে আর যেতেও মন চাইত না। একইসঙ্গে জীবনযুদ্ধ। খেলাধুলা বাদ দিয়ে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। পেশাগত কারণে মাংস ব্যবসায়ীদের একটি জায়গায় নিয়ে আসতে, একত্র করতে ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতি’ গঠন করি। সংগঠনের সংবাদ নিয়ে পত্রিকার অফিসে যাওয়া-আসা করি। একসময় বাংলার বাণীর শিশু-কিশোর সংগঠন শাপলা কুড়ির আসরের দাদা ভাই ওহায়েদুর রশিদ মুরাদের সঙ্গে পরিচয় হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার টান দেখে, সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা দেখে রায়ের বাজার শাপলা কুড়ির আসরের শাখা করার দায়িত্ব দেন, সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই। ১৯৮০ সালে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য হতে সক্ষম হই। খুরশিদ আলম ও গফুর ভাইয়ের কমিটিতে ৮৬ সালে প্রচার সম্পাদক, ৯২ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক, ২০০২ সালে যুগ্ম-সম্পাদক, বর্তমানে ৩৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বপালন করছি। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছি। সংগঠনের জন্য আজও কাজ করছি। অনেক প্রতিকূলতাও মোকাবেলা করতে হয়েছে এই সময়ে। কিন্তু পিছপা হইনি কখনো। বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতি মোকাবেলা করেছি আজও।
সুদীর্ঘ ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে খুনি মোশতাকের জনসভা প- করা, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে মাংস ব্যবসায়ীদেরকে নিয়ে মিছিল করি। সবই দেখেছে দেশবাসী। কিন্তু বিনিময়ে কী পেয়েছি? সজল হত্যাসহ অসংখ্য মিথ্যা মামলার আসামি হতে হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় অনেক জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে ৭ বছর বাড়ি ছাড়া ছিলাম। এই সময়ে জেলখানাতেও জীবন কাটাতে হয়েছে।
১৯৮৬ ডা. ফিরোজা বেগম সাজেদা চৌধুরী, আলহাজ্ব মকবুল হোসেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক এর নির্বাচনে সাদেক খানের মাধ্যমে দায়িত্বপালন করি। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কার কর্মীÑ মকবুল নাকি নানক? আমরা কি কখনো আওয়ামী লীগের কর্মী হতে পারব না? না হতে দেওয়া হবে না?
রাজনীতি করে আসছি মহৎ উদ্দেশ্যেই। মানবসেবা ছাড়া সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়াইনি কখনো। তখনকার রাজনীতি ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা, গান, নাটক দিয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। শোকসভা স্মৃতিচারণ, বিপদগ্রস্ত কর্মীদেরকে সম্মিলিত সহযোগিতা করা। জনগণকে জাগ্রত করে দলীয় কর্মসূচি সফল করা। নির্বাচনি প্রচারে দেয়ালে দেয়ালে নৌকা আঁকা। এখন দলীয় অফিসে যাওয়া, অসহনীয় গরমের মধ্যে ঘণ্টা তিনেক বসে নেতার বক্তব্য শুনতে হবে। শোকসভা, স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃতি, কর্মীদের সহযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কোথাও কোনো ওয়ার্ড আওয়ামী লীগে দেখা যায় না বললেই চলে। এমনভাবে কর্মী তৈরি করা যায় না। যে রাজনৈতিক দর্শন, আদর্শ বাস্তবায়নে রাজনীতি শুরু করেছিলাম তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। নেতাদের ইচ্ছার ব্যতয় ঘটলে এমপি-মন্ত্রীদের অশোভন আচরণের শিকার হতে হয়, তখন নিজেকে মনে হয় কৃতদাস। এখনকার রাজনীতিতে আগের মতো সেই আন্তরিকতা, ঐক্যবদ্ধতা, একে অন্যের বিপদ-আপদে এগিয়ে যাওয়া, অসহায় মানুষের পাশের থাকার দৃশ্য দেখা যায় না বললে কি ভুল হবে? মানবকল্যাণহীন রাজনীতি করে পরিচিতি পাওয়া যায়, মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায় না।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি
সম্পাদনা: আশিক রহমান