নাস্তিকতায় বাধা নেই, তবে ধর্মকে কটাক্ষ নয়
ইকতেদার আহমেদ
নাস্তিক শব্দটির বিপরীত শব্দটি হলো আস্তিক। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসীদের বলা হয় নাস্তিক। আর সৃষ্টিকর্তা, মৃত্যুর পর জীবন ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি বিশ্বাসীদের বলা হয় আস্তিক। নাস্তিকেরা নিজেদের প-িত ও জ্ঞানী ভেবে থাকেন। বস্তুত তাদের জ্ঞান অজ্ঞ-মূর্খদের জ্ঞানের চেয়েও সীমিত। অজ্ঞ-মূর্খ বলতে অক্ষরজ্ঞানবিহীন ব্যক্তি অথবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করেনি এমন ব্যক্তিকে বোঝায়। একজন অজ্ঞ-মূর্খ তার স্বাভাবিক জ্ঞান দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজে পায়। একজন স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির নাস্তিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একজন স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উপলব্ধি করতে সক্ষম যে, এ পৃথিবীতে তার আগমন নিছক উদ্দেশ্যবিহীন নয়।
আমাদের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিককে আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে যেকোনো ধর্মাবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ অধিকার একজন নাগরিকের কোনো ধর্ম পালন না করার অধিকারকে খর্ব করে না। আমাদের মূল আইন দ-বিধিতে যেকোনো ধর্মাবলম্বলীর ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা বা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূমিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন অনুযায়ী ইন্টারনেট ও কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দ-নীয় অপরাধ।
সদ্য প্রয়াত জনৈক কবি ও সাহিত্যিকের সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণের জন্য যখন কিছু সংখ্যক সংবাদ মাধ্যম ও ব্যক্তি তাকে সাব্যসাচী অভিহিত করে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশে ব্রতী হয়, তখন সমভাবে তার নাস্তিকতার প্রসঙ্গটিও আলোচনায় আসে।
দেশের ৯০ ভাগের অধিক লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং ঐতিহাসিকভাবে দেশের জনমানুষ ধর্মপ্রবণ। বাঙালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি গানে ব্যক্ত করেনÑ ‘মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’ তার গানের মধ্যে সন্নিবেশিত এ বাক্য দ্বারা ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় বিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি এবং তার মৃত্যু পরবর্তী এ দেশের মানুষ তার রচিত গানে ব্যক্ত আকাক্সক্ষা পূরণে তাকে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের প্রাঙ্গনে সমাধিস্থ করেন। জাতীয় কবির মনোবাঞ্ছনা ও আকাক্সক্ষার বিপরীত সদ্য প্রয়াত কবি তার রচিত মরা ময়ূর কাব্য নাট্যে মধুর আযানের ধ্বনিকে তার দৃষ্টি ও বিশ্বাসে উপদ্রব গণ্যে বলেনÑ ও কাক! তুই খুব জোরে কা কা কর, যেন মুয়াজ্জিন এর আযান শোনা না যায়।’
একজন মুসলমানকে পাঁচটি বিষয় যথা ঈমান, রোযা, নামাজ, হজ্জ ও যাকাতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের জন্য দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরয। এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য মুসলমানদের উপাসনালয় মসজিদ হতে প্রতিদিন পাঁচবার আযানের মাধ্যমে আহ্বান করা হয়। ধর্মপ্রাণ যেকোনো মুসলিমের নিকট আযানের ধ্বনি অতি মধুর। আর তাই দেখা যায়, সভা বা যেকোনো অনুষ্ঠান চলাকালীন আযানের ধ্বনি শোনা গেলে আযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সভা বা অনুষ্ঠানের কাজ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। মহিলাদের দেখা যায়, আযানের বাণীর প্রতি সম্মানের বহিঃপ্রকাশে মাথা উন্মুক্ত থাকলে তা শাড়ির আঁচল বা ওড়না দিয়ে আবৃত্ত করে নেয়।
প্রয়াত কবির নিকট আযানের মধুর ধ্বনি উপদ্রব ঠেকলেও কাকের কা কা শব্দ উপদ্রব নয়। অথচ কাকের কা কা শব্দকে উপদ্রব মনে করেন না এমন লোক এ দেশে বিরল। প্রয়াত কবির দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক, অপরদিকে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানুষের ধর্মানুভূতির উপর চরম আঘাত। তার কাব্যনাট্যে উল্লেখিত বাক্যটি আমাদের মূলদ- আইন দ-বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং তার জীবদ্দশায় এ বিষয়ে মামলা হলে সাজা এড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। যেহেতু একজন অপরাধীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অপরাধেরও মৃত্যু হয়, সেহেতু কবিতার মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন বাক্যের উল্লেখ থাকায় ব্যক্তি হিসেবে তার অপরাধের মৃত্যু ঘটলেও কবিতাটিতে বাক্যটির অবস্থান অপরাধটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর তাই সরকারের জন্য এ কাব্যনাট্যটি নিষিদ্ধ করা অত্যাবশ্যক।
নাস্তিক দুই ধরনের। এর একটি নাস্তিকতার বহিঃপ্রকাশে কখনো কোনো ধরনের অবমাননাকর ও আপত্তিকর বাক্য ব্যক্ত করে না। আর অপরটি নিজেদের মহাজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় অপরের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে এমন অবমাননাকর ও আপত্তিকর বাক্যের প্রকাশ ঘটায়, যা প্রকৃতপক্ষে ইচ্ছাকৃত বা বিদ্বেষপূর্ণভাবে কটাক্ষের নামান্তর। একজন আস্তিকের মধ্যে নৈতিকতা, নীতিজ্ঞান ও মূল্যবোধ প্রবল। পক্ষান্তরে একজন নাস্তিকের মধ্যে নৈতিকতা, নীতিজ্ঞান ও মূল্যবোধ শিথিল। এ শিথিলতার কারণে অতি সহজেই তাদের অনেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন। এদেশে সে বিচ্যুতি আমরা সদ্য প্রয়াত কবিসহ আরও কতিপয়ের মধ্যে দেখে আসছি।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান