গুরুত্বপূর্ণ কিছু সহজ আমল
মুফতি জাহিদুজ্জামান
জান্নাত আরবি শব্দ, অর্থ বাগান বা উদ্যান। যে সব মুসলমান ভাই ও বোনেরা দুনিয়ায় আল্লাহ তা’য়ালার আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এবং হাশরের ময়দানে যার পাপের চেয়ে পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা যে সব স্বর্গ প্রস্তুত রেখেছেন তাকেই জান্নাত বলে। প্রচলিত বাংলা ভাষায় একে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেহেশত বলা হয়। একজন মোমিন মুসলমান নিচের আমলগুলো করলে সহজে জান্নাত লাভ করতে পারে।
ক. যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ‘আয়াতুল কুরসি’ পাঠ করবে, সে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। (বায়হাকি)
খ. যে ব্যক্তি ফজর ও মাগরিবের নামাজ শেষে ‘আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান্নার’ সাতবার পাঠ করবে সে যদি ওই রাতে বা দিনে মারা যায় তাহলে অবশ্যই জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। (সুনানে আবু দাউদ)
গ. যে ব্যক্তি সকালে ‘আউজু বিল্লাহিস সামিয়িল আলিমি মিনাশ শায়তনির রাজিম’ তিনবার পড়ার পর সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত একবার পাঠ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করবেন, যারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকবে। আর যদি সে ব্যক্তি ওই দিন মারা যায় তাহলে শহীদি মৃত্যু লাভ করবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এ আমল করবে সেও ওই সম্মানের অধিকারী হবে। (সুনানে তিরমিজি)
ঘ. যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে ‘সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার’ দিনে পড়বে, সে যদি ওইদিন সন্ধ্যা হওয়ার আগে মারা যায় তাহলে সে জান্নাতে যাবে। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে রাতে পড়বে, সে যদি সকাল হওয়ার আগে মারা যায় তাহলে সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সহিহ বোখারি)
ঙ. যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার এ দোয়াটি পড়বে (রাদিতু বিল্লাহি রাব্বাও ওয়া বিল ইসলামি দ্বীনাও ওয়া বি মুহাম্মাদিন নাবিয়্যাও ওয়া রসুলা) আল্লাহ তায়ালার ওপর অবধারিত হবে কেয়ামাতের দিন তাকে (জান্নাত দানের মাধ্যমে) খুশি করা। (সুনানে তিরমিজি)
আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গবেষণার অপার সুযোগ পর্যটন
পর্যটন মানুষের এক সহজাত নেশা। এ নেশার ডাকে মানুষ ঘর ছেড়ে ঘুরে বেড়ায় প্রকৃতির রাজ্যে। পাহাড় থেকে বনে, বন থেকে সমুদ্র-তীরে। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে এভারেস্টের শৃঙ্গ পর্যন্ত। পর্যটন ব্যতীত ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভব নয়। ভাবুকদের জন্য এ পর্যটন ইবাদত। পর্যটনে মহান আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তা-গবেষণার সুযোগ হয়। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি এ উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণ করেনি, যাতে তারা সমঝদার হৃদয় ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে? বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ হয় না, কিন্তু বক্ষস্থিত অন্তরই অন্ধ হয়।’ সুরা হজ : ৪৬
পর্যটন শিক্ষা ও দূরদৃষ্টি অর্জনের মাধ্যম। আয়াতে শিক্ষার মানসিকতা ও দূরদৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ ভ্রমণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ‘ফাতাকুনা লাহুম কুলুবুন’ বাক্যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, অতীত কাল ও অতীত জাতিগুলোর অবস্থা সরেজমিন প্রত্যক্ষ করলে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়। ইবনে আবি হাতেম কিতাবুত তাফাক্কুরে মালেক ইবনে দিনার থেকে বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা মুসা আ. কে আদেশ দেন, লোহার জুতা ও লোহার লাঠি তৈরি কর এবং আল্লাহর পৃথিবীতে এত ঘোরাফেরা কর যে, লোহার জুতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায় এবং লোহার লাঠি ভেঙে যায়।’ রুহুল মায়ানি
মানুষ চিরকালই প্রকৃতির অনুরাগী। প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। মানুষও সেই ডাকে সাড়া দিয়ে জল, স্থল ও আকাশপথে বের হয়ে যায়। এজন্য বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গড়ে উঠেছে বিচিত্র পর্যটন কেন্দ্র। এ সুন্দর পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিকুলের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাগুলোর চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে যে পানি নাজিল করেছেন, তার দ্বারা মৃত জমিনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব রকম জীবজন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালা, যা তারই হুকুমের অধীনে আসমান ও জমিনের মাঝে বিচরণ করেথ নিশ্চয়ই সেসব বিষয়ের মাঝে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সুরা বাকারা : ১৬৪)।
জলপথে পর্যটন সবচেয়ে মধুর ও আনন্দঘন। কখনও ছায়াময়-মায়াময় প্রকৃতির সুনিবিড় নিকুঞ্জ অবলোকন, কখনও প্রবল বর্ষণ ও ঘূর্ণিপাকে ভীতি-সঞ্চারিত তনুমন। কখনও বিচিত্র পশুপাখি ও জীবজন্তুর দর্শন, কখনও নাম না জানা অজ¯্র ফলে-ফুলে ভরা উদ্যান। কখনও গভীর সমুদ্রের লাবণ্য গোচরিত হয়, কখনও উত্তাল ঢেউয়ের কোলে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি জাগে পর্যটক-মনে। পানির ওপর নৌকা-জাহাজসহ জলযানগুলোর চলাচল মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বেরই অনন্য নিদর্শন। পানি আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত। পানিকে তিনি এমন তরল করে সৃষ্টি করেছেন, তা তরল ও প্রবাহমান হওয়া সত্ত্বেও তার পিঠে লাখ লাখ মণ ওজনবিশিষ্ট বিশালাকায় জাহাজ বিরাট ওজনের চাপ নিয়ে চলাচল করে। এগুলো গতিশীল করে তোলার জন্য বাতাসের গতির পরিবর্তন মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও শ্রেষ্ঠত্বেরই ইঙ্গিত বহন করে। (জাসসাস)।
পর্যটন শুধু আনন্দ-বিহার ও বিনোদ-বিলাসের মাধ্যম নয়, এর উদ্দেশ্য মানুষের বহুমাত্রিক বিভিন্নতার মধ্যে অভিন্ন যোগসূত্র সন্ধান করা। একজন মানুষ যখন অপর ভাষাভাষী ও বর্ণের মানুষের মধ্যে তার আবেগ, স্বপ্ন ও ব্যথার উপস্থিতি দেখতে পায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি এক আন্তরিক মমত্ববোধ ও আত্মীয়তার অনুরাগ জাগে। এখানেই এ বিভিন্নতার তাৎপর্য ও কল্যাণকারিতা। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘হে মানব! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও।’ সুরা হুজরাত : ১৩
পর্যটন শিল্পের জন্য বাংলাদেশ একটি আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য গ্রীষ্মের দুঃসহ দাহন, বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি, শরতের কাশফুল, হেমন্তের কুহেলী গুঞ্জন, শীতের শীর্ণ নদী ও কুয়াশার নেকাব আর বসন্তের দখিনা মৃদুমন্দ বাতাস পর্যটক-মনে প্রেমের দোলা দেয়। তাছাড়া চিরচেনা নৈসর্গিক দৃশ্য, সমুদ্র-সৈকত, পাহাড়-পর্বত, বিস্তর বনভূমি, পার্বত্যাঞ্চল, ঐতিহাসিক নিদর্শন, ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তি ও মনীষীদের সমাধি, স্মৃতিস্তম্ভথ এ সবকিছুই ভ্রমণপিয়াসী মানুষকে চিরকাল আকর্ষণ করেছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বিমোহিত করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে এ দেশে এসেছিলেন বহু ইতিহাসবিদ ও পর্যটক। ইবনে বতুতা, ইবনে খালদুন, হিউয়েন সাং ও ভাস্কো দা গামা তাদের মধ্যে অন্যতম।
আজকের ফিলিস্তিন, জাজিরাতুল আরব, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, তুরস্ক, ইরানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে প্রকৃতির প্রাচীন নিদর্শনাবলি আজও জ্বলজ্বল করছে। এসবের সামনে দাঁড়ালে যে কোনো মানুষের মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। কোনো ঈমানদার তা দেখে স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ পাকের মহত্ত্ব ও তার বিধান সম্পর্কে নতুনভাবে উপলব্ধি করে। তাই পর্যটন জ্ঞান অর্জন, শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যম ও ঈমানকে মজবুত করার সহায়ক। পর্যটন বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সম্পর্ক রচনার এক অনন্য সেতুবন্ধন। ঘরে বসে থেকে কিংবা প্রকৃতি ও মানুষের দ্বারস্থ না হয়ে কেউ মহাজাগতিক সত্যের সন্ধান লাভ করতে সমর্থ হবে না। জীবন ও জগতের প্রকৃত রহস্যকে জানার জন্য পর্যটন জরুরি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট