
একটি সেলফি ও মিথ্যাচারের গল্প
লিহান লিমা: সিলেটে ছাত্রলীগকর্মী বদরুলের হামলায় সংকটাপন্ন কলেজছাত্রী নার্গিস বেগম খাদিজাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন যুব মহিলা লীগের তিন নেত্রী। খাদিজাকে দেখতে যাওয়ার ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘সেলফি’ও তুলেছিলেন তারা। পরে নিজেদের উদারতা ও মহত্ব জাহির করতে ব্যক্তিগত প্রফাইলে ছবি আপলোড ও শেয়ার করেন। সমালোচনার মুখে ওয়াল থেকে ছবিগুলো সরিয়ে ফেললেও আত্মপক্ষ সমর্থন ও সমালোচকদের উল্টো আক্রমণ করতে ভুলে যাননি জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিন, যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল ও যুগ্ম সম্পাদক কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি। একপর্যায়ে সেলফি তোলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন তিন নেত্রী। কিন্তু প্রশ্ন হলো আদৌ তারা অপরাধবোধে ভুগছেন কিনা? এবং এর পাশাপাশি আরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়; যেসবের উত্তর খুঁজে পাওয়া আদতে মুশকিল।
ইনটেনসিভ কেয়ারে ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ, বিনা অনুমতিতে কারও ছবি তোলা এবং তার ব্যক্তিগত অবস্থার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা বে-আইনি। আর সেলফি আত্ম-আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু তিন নেত্রীর ফেসবুক স্ট্যাটাস বিশেষ করে এমপি ও অপু উকিলের ফেসবুক স্ট্যাটাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নিজেদের কাজ নিয়ে তারা মোটেও লজ্জিত নন। আবার অপরাধ ঢাকতে গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লজ্জাজনকভাবে মিথ্যাচারও করেছেন।
সংসদ সদস্য তুহিন বিবিসি বাংলাকে তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন,‘এটি সেলফি নয়, ছবিটি তার ভাই তুলেছিলেন এবং মেয়েটি মারা যায়নি এটি বোঝানোর জন্য তারা ছবি আপলোড করেছেন।’
এমপির কাছে দুটি প্রশ্নÑ প্রথমত, এটি যদি সেলফি না হয়, তাহলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ার সুবাদে তারা কজন মিলে ইনটেনসিভ কেয়ারে প্রবেশ করেছিলেন? যেখানে শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে রোগীর একান্ত নিকটাত্মীয়দের প্রবেশের অনুমতি মেলে।
দ্বিতীয়ত, খাদিজা বেঁচে আছে এটি প্রমাণ করার জন্য মুমূর্ষু খাদিজার ছবি তুলে তাকে জীবিত প্রমাণ করা ছাড়া কি আর কোনো বিকল্প উপায় ছিল না?
বিবিসি বাংলার সঙ্গে আরেক সাক্ষাৎকারে অপু উকিল বলেছেন, ‘তিনি কোনো ছবি তোলেননি।’ তার কাছে প্রশ্ন, তিনি যদি কোনো ছবি না তোলেন তাহলে ছবিতে অপু উকিলের মতো দেখতে যিনি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি কে ছিলেন?
একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এ ধরনের ছবি তোলা যুক্তি-যুক্ত ও উচিত না। তবে যারা ছবি তুলেছে তাদের কোনো অশুভ উদ্দেশ্য ছিল না।’ উদ্দেশ্য শুভ কিংবা অশুভ হোক, পেশার খাতিরে অপু উকিলের এটি স্বাভাবিকভাবেই জানার কথা যে, বিনাঅনুমতিতে কারও ছবি তোলা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা বেআইনি ও কিছু ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দ-নীয় অপরাধ।
মজার বিষয় হলো, উকিল মহোদয়া একই সঙ্গে দুঃখ প্রকাশও করছেন আবার নিজেদের সপক্ষে যুক্তিও দাঁড় করাচ্ছেন। এছাড়া অপু উকিল বলেছেন, ছবি তোলার বিষয়টি তার অগোচরে হয়েছে এবং সাংসদ তুহিনের আইডি হ্যাক হয়েছে। যদিও তুহিন এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। আবার অপু উকিল নিজেই অপূর্ব ম-লের আইডি থেকে খাদিজার সঙ্গে ছবি তোলার পোস্টটি শেয়ার করেছিলেন। তিনি যদি ছবি নাই তোলেন তাহলে তিনি পোস্টটি শেয়ার করলেন কেন? আমরা কি এটি ধরে নেব যে, তার আইডিও হ্যাক হয়েছিল এবং বিষয়টি তিনি বলতে ভুলে গিয়েছিলেন?
এমপি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, তিনি যে নির্যাতিত খাদিজার পাশে আছেন তা বোঝানোর জন্য ছবি তুলেছিলেন। লোক দেখানো বিষয়টি বাদ দিলে নিজের মন্তব্যের প্রতি যদি তিনি অটল থাকেন তাহলে ফেসবুক থেকে ছবিটি সরিয়ে ফেললেন কেন?
যদিও ইনটেনসিভ কেয়ারে প্রবেশ, ছবি তোলা ও ফেসবুকে আপলোড করা নিয়ে আদৌ কোনো মাথাব্যথা নেই সাংসদের। দোষারোপের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে তার মাথাব্যথা হলো বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গোলাপি লিপস্টিক নিয়ে সমালোচনা করা হয় না কেন? আরেক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তুহিন সুশীল সমাজের দোষ দিয়ে বলেছেন, যে ছাত্রলীগকর্মী ইমরান খাদিজাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে তার ব্যাপারে কেউ কোনো কথা না বলে ছাত্রলীগের দোষ খুঁজছে। ইমরানের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানা গেছে, সদ্য এইচএসসি পাস করা ইমরান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই জড়িত না ও তার পরিবার থেকে রাজনীতিতে যোগদানের ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।
সবশেষে বলা যায়, একটি মিথ্যাকে ঢাকতে আরও অনেক মিথ্যার প্রয়োজন হয়। তবে, এত মিথ্যার ভিড়ে খাদিজার উপর মরণঘাতী আক্রমণের মতো অমোঘ সত্য বিষয়টিকে কেউ যেন এড়িয়ে না যায়। সম্পাদনা: পরাগ মাঝি
