নয়াদিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফ সম্মেলন অনুষ্ঠিত টেকনাফে ২৮২ কি:মি. কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করবে বাংলাদেশ
গরু চোরাচালান বন্ধ হলে ৯৫ শতাংশ সীমান্ত হত্যা কমে আসবে * ভারতের গরু আমাদের প্রয়োজন নেই * সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে বেড়া নির্মাণে বিএসএফ’র প্রস্তাবে বিজিবির সম্মতি * বিএসএফ’কে পলাতক ২৩০ অপরাধীর তালিকা দিয়েছে বিজিবি
ইসমাঈল হুসাইন ইমু: শিগগিরই বাংলাদেশ-ভারতের টেকনাফ সীমান্তে ২৮২ কি.মি. সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর বিজিবি(বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ) ও বিএসএফ’র (ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) মধ্যে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চূড়ান্ত করা হয়। এখন অর্থ বরাদ্দ পেলেই নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফ’র মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বিষয়ে বৈঠক থেকে ফিরে গতকাল শুক্রবার পিলখানায় বিজিবির সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ।
সম্মেলনে সীমান্তের দেড়শ’ গজের মধ্যে নতুন করে বেড়া নির্মাণে বিএসএফ-এর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে বিজিবি। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় আড়াইশ’ গ্রামের সুরক্ষার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পলাতক ২৩০ অপরাধীর তালিকা বিএসএফ এর কাছে হস্তান্তর করেছে বিজিবি। এই তালিকায় ছোট-বড় সব ধরনের অপরাধীদের নাম রয়েছে বলে জানান আজিজ আহমেদ।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতের নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত সম্পর্কিত সকল বিষয় নিয়ে সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদের নেতৃত্বে ২২ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। অপর দিকে বিএসএফ মহাপরিচালক কে কে শর্মার নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধি দল সম্মেলনে অংশ নেয়।
মেজর জেনারেল আজিজ বলেন, প্রথমে টেকনাফ সীমান্তে ২৮২ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে সকল সীমান্তে বেড়া নির্মাণ করা হবে। তবে এতে সময় লাগবে। তিনি বলেন, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নাই, টহল দেওয়ার জন্য সড়ক নাই। যেসব এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নাই এবং নদী আছে সেসব এলাকা দিয়ে চোরাচালান বেশি হয়। ইয়াবা আমাদের জন্য এলার্মিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কাঁটাতার নির্মাণ হলে ইয়াবাসহ অন্যান্য চোরাচালান বন্ধ হবে। তিনি বলেন, ভারত তাদের সীমান্তের ৭৯ শতাংশে কাঁটাতারের বেড়া সম্পন্ন করেছে। এই বেড়া নির্মাণে দীর্ঘদিন কাজ করছে ভারত। এতে প্রচুর অর্থ খরচ হয় তাদের।
সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, গরু চোরাচালান বন্ধ করা গেলে ৯৫ শতাংশ সীমান্ত হত্যা কমে যাবে। এর জন্য গরু চোরাচালানকারীদের প্রতিরোধ করতে হবে। মূলত সীমান্ত হত্যার ৯৫ শতাংশই গরু চোরাচালানের জন্য হয়ে থাকে। দেশি গরুর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের গরু আমাদের প্রয়োজন নেই।
বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, আগে প্রতিরাতে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অন্তত ১৫০০ গরু আসতো। কিন্তু এবার কুরবানির ঈদে চারশ থেকে পাঁচশ ভারতীয় গরুর বেশি আসতে দেওয়া হয়নি। চোরাই পথে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ করলে সীমান্ত হত্যা কমে আসবে।
আজিজ আহমেদ বলেন, নয়াদিল্লির বৈঠকে বিএসএফ মহাপরিচালককে গরু চোরাচালান বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ বিষয় বিএসএফ মহাপরিচালক সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন।
প্রতিবছর সীমান্ত হত্যার সংখ্যা কমে আসছে উল্লেখ করে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, এ বছর বিএসএফ’র গুলিতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ১৫৭ জন আহত হয়েছেন। গত বছর ৪৫ জন নিহত হয়েছিলেন।
মেজর জেনালের আজিজ জানান, সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক কে কে শর্মা বলেছেন, ভারতীয় সীমান্তের বিভিন্নস্থানে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট কাঁটাতারের বেড়ার বাহিরে এবং সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কিছু কিছু জনবসতি থাকায় সেখানে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বেশি লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের বেশকিছু জনবসতি ইতোমধ্যে একস্তর বিশিষ্ট কাঁটাতারের বেড়ার আওতায় আনায় ওই সব এলাকার সীমান্ত অপরাধ অনেক কমে এসেছে। এ প্রেক্ষিতে বাকি এলাকাগুলোতে বেড়া গেট সংযোজনসহ স্থাপনের লক্ষ্যে তিনি বিজিবির সহযোগিতা কামনা করেন।
বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, সীমান্ত নিরাপত্তার বৃহত্তর স্বার্থে ইতিপূর্বে ১৫০ গজের মধ্যে একস্তর বিশিষ্ট কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনে সহযোগিতা করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে বিএসএফকে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের এই সম্মতিতে কে কে শর্মা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশের এই সহযোগিতামূলক আচরণের জন্য সীমান্ত এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকা- কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বিএসএফ’কে পলাতক ২৩০ অপরাধীর তালিকা দিয়েছে বিজিবি : আজিজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ থেকে পলাতক ২৩০ অপরাধীর তালিকা বিএসএফ এর কাছে হস্তান্তর করেছে বিজিবি। এই তালিকায় ছোট-বড় সব ধরনের অপরাধীদের নাম রয়েছে। প্রতিটি সীমান্ত সম্মেলনেই অপরাধীদের তালিকা হস্তান্তর করা হয় উল্লেখ করে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, মন্ত্রণালয়সহ দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে এসব অপরাধীর তালিকা সংগ্রহ করি। এবারও আমরা বিভিন্ন ধরনের পলাতক অপরাধীদের একটি তালিকা বিএসএফ’র কাছে দিয়েছি।
এ বিষয়ে ভারতের বিএসএফ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা আমাদের সহযোগিতা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। অতীতেও তারা পলাতক সন্ত্রাসীদের আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে বিজিবির পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন বিএসএফ মহাপরিচালক। তারা আমাদের কাছে অধিকতর সহযোগিতাও চেয়েছেন।
আজিজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ কখনো তার ভূমি কোনো পক্ষকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ দেয় না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। বিজিবি মহাপরিচালক ভারতের কারাগারে সাজার মেয়াদ উত্তীর্ণ বাংলাদেশিদের যথাসময়ে দেশে ফেরত নিয়ে আসার বিষয়ে উভয়পক্ষ সমন্বিতভাবে কাজ করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সম্পাদনা : উম্মুল ওয়ারা সুইটি