কোনো খাদিজাকেই যেন আর এমন হামলার শিকার হতে না হয়
ওয়াসিম ফারুক
দেশে আজ একদিকে মানুষ খাদিজার জন্য প্রার্থনা করছেন, অপরদিকে বদরুলকে জানাচ্ছেন ধিক্কার। অশ্রু ও ক্ষোভের মিলনে সবাই যেন রাগে অগ্নিশিখা। ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজা বেগম নার্গিস বর্বরোচিত চাপাতি হামলার শিকার হন নিজ কলেজেরই কাছে। হামলাকারী বদরুল আলম সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। বদরুলের রাজনৈতিক পরিচয় কি তা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বদরুল সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা হলো, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মনিরগাতি গ্রামের মৃত সাইদুর রহমানের ছেলে বদরুল চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে বদরুল দ্বিতীয়। মা দিলারা বেগম ছেলের অপকর্মের সংবাদ শোনার পর থেকেই অসুস্থ। ছেলে এমন নৃশংস কাজ করতে পারে তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না তিনি।
ছেলেবেলা থেকেই কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল হলেও পড়ালেখায় বরাবরই মেধাবী ছিল বদরুল। টানাপড়েনের সংসারে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার পাশাপাশি এসএসসি ও এইচএসসিতেও ভালো ফল করে সে। এরপর ভর্তি হয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভাবের কারণে শাবিতে ভর্তি হওয়ার পরপরই লজিং মাস্টার হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল খাদিজাদের বাড়িতে। কিন্তু খাদিজাকে দেখার পর থেকেই বদরুলের লাম্পট্য বেড়ে যায়, প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়ে অনেকটাই উদাসীন হয়ে পড়ে বদরুল।
ছাত্রলীগের একজন সাধারণ কর্মী ছিল বদরুল। মিছিল-মিটিংয়ে মাঝে মধ্যে হয়তো যেত, অংশগ্রহণ করত। ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারির একটি ঘটনা বদরুলকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের প্রথম সহ-সম্পাদক পদ পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। উক্ত তারিখে খাদিজাকে উত্যক্ত করতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হয় বদরুল। সেদিনের সেই গণধোলাইকে বদরুল ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সমর্থ হয়। গণধোলাইয়ের ঘটনাকে শিবিরের হামলা হিসেবে প্রচার করে ছাত্রলীগসহ অনেকের সহানুভূতি আদায় করতে সমর্থ হয়।
ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন। তার ইতিহাসÑ ঐতিহ্য ও গৌরবের, সংগ্রাম ও সাফল্যে ম-িত। সংগঠনটি ১৯৪৮ সালের পর থেকে বহু ত্যাগ স্বীকার করে দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছে। প্রায় প্রত্যেকটি গণ-আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান রাজনীতিতে মেধার চেয়ে পেশীশক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় বিধায় ছাত্রলীগের রাজনীতিও তার বাইরে যেতে পারেনি।
ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধংসাত্মক এবং আইনবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ৯ ডিসেম্বর ২০১২ ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নেতাকর্মী বিনা কারণে, প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষ, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে নৃশংসভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে দর্জি বিশ্বজিৎ দাসকে। ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় জড়িত কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে মামলা করা হয়। বিচারও হয়। কিন্তু ছাত্রলীগ কি ফিরেছে সঠিক জায়গায়?
ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেই খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে। দলীয় কোন্দলে নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও খুনোখুনির ঘটনা প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে। ছাত্রলীগের নানা অপকর্মে একসময় খোদ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একসময় ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব ছেড়েছিলেন।
মানুষ অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছে যখন কোনোকিছু যাচাই-বাছাই করার আগেই বিবৃতি দেওয়া হলো, বদরুল ছাত্রলীগের কেউ না। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আসা এমন বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদিজার উপর হামলার ব্যাপারে বলতে গিয়ে বলেছেন, অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, তাকে সাজা পেতেই হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর আমরা এখন অনেকটাই আশ্বস্ত, কোনোভাবেই খাদিজার উপর হামলাকারী আইনের হাত থেকে রক্ষা পাবে না বলে বিশ্বাস করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মতোই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে এমন বক্তব্য আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সেই সৎ সাহসটুকু দেখাতে পারেননি বললে কি ভুল হবে?
আজকের ছাত্র সংগঠনের নেতারা ভবিষ্যতে হয়তো দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত হবেন। কিন্তু তারা যদি প্রথমেই কোনো ছলচাতুরি বা মিথ্যার আশ্রয় নেন তাহলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কি সংকটে পড়বে না?
খাদিজার উপর হামলাকারী এখন আইনের হাতে বন্দি। মানুষ চায়Ñ এই হামলার সুষ্ঠু বিচার। কোনো খাদিজাকেই যেন আর এমন হামলার শিকার হতে না হয়। কোনো অপবাদ যেন না হয় ছাত্রলীগের। প্রত্যাশা এখনÑ খাদিজা আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, ছাত্রলীগ ফিরবে কি তার ঐতিহ্যের ধারায়।
লেখক: কলামিস্ট / সম্পাদনা: আশিক রহমান