সমাজ থেকে সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে
তাহসিনা আক্তার
গুরুতর আহত সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমরা দেখেছিÑ কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু, পুলিশ কর্মকতার স্ত্রী মিতুসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকা-। কোনো একটি হত্যাকা-েরও কি এখনো পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়েছে? প্রাপ্য বিচারটি কি পেয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো? পায়নি। একেকটি ঘটনা ঘটছে, নতুন ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা, পুরোনোটিকে ভুলে যাচ্ছি আমরা। সমাজে এখন সবচেয়ে লঘু অপরাধ বোধহয় মানুষ হত্যা! যেকোনো হত্যাকা-ের বিচারকাজ দীর্ঘদিন ধরে চলে। হত্যার প্রমাণ সহজে পাওয়া যায় না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটিও সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হয় অনেকসময়।
খাদিজার সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটল তা অনেক মানুষের সামনে ঘটেছে। কিন্তু তাকে বাঁচাতে বা সন্ত্রাসীকে প্রতিরোধ করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনটি সমাজে প্রায় ঘটতে দেখা যায়। কারণ, আইনগত অনেক জটিলতা এখানে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আইনী জটিলতা এড়াতে চায় মানুষ। এর ফলে কেউ এগিয়ে আসতে চায় না।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে যেসব দেশ রয়েছে, যেমন ইংল্যান্ডের দিকে তাকালে দেখা যাবে, কোনো একটি ঘটনা ঘটলে, আইনের আশ্রয় চাইলে সহজে সহায়তা পাওয়া যায়। কোনো মানুষ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কেউ যদি মনে করে তার আইনের দ্বারস্থ হওয়া প্রয়োজন তাহলে তিনি সঠিক বিচার বা প্রতিকার পেতে পারেন। একটা বিশ্বাসের স্থান হিসেবে মানুষ আইনের আশ্রয়কে বেছে নেয়। ধরে নিইÑ কোনো একটি সত্য ঘটনার সাক্ষী আমি, প্রতিরোধে যদি এগিয়ে যাই তাহলে দেখা যাবে, আমি সেই ক্ষমতাবানদের দৃষ্টিতে পড়ে যাব। তার ফলে দেখা যাবে, কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। কোনো ধরনের অপরাধ না করেও আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এখানেই আসলে বড় সমস্যা। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এগিয়ে যাই না। এমনটিই এখন সমাজের বাস্তবতা।
এ ধরনের নৃসংসতম ঘনটার পেছনে সামাজিক অবক্ষয় তো রয়েছেই। অবক্ষয়ের সঙ্গে আইনেরও একটি সম্পর্ক আছে। যে সমাজ বা রাষ্ট্রের নাগরিকেরা আইন মেনে চলে, সে সমাজে সামাজিক অবক্ষয়ের পরিমাণও কম হয়। আমাদের এখানে আইনগতভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না সবসময়, যার জন্য সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার হাতে ক্ষমতা আছে, যার কাছে অর্থ আছে, তার হাতে সাধারণ জনতা বন্দি হয়ে পড়ছে।
বর্বরোচিত এমনসব অপরাধ যারা ঘটাতে চাচ্ছে বা ঘটাচ্ছে তার পেছনে কোনো না কোনো শক্তিশালী ক্ষমতা বা ছায়া কাজ করে। অপরাধ সংঘটিত করে অপরাধী সেই শক্তিশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা ছায়ার পেছনে গিয়ে লুকাতে পারছে। যার কারণে সমাজ থেকে সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। কোনো একটি অপরাধ রাস্তায় বা কারও সামনে সংঘটিত হলেও কেউ আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। দুর্ঘটনায় পতিত মানুষটি চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে যায় না আইনগত জটিলতার কারণে।
পরিচিতি: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত গ্রহণ: শরিফুল ইসলাম / সম্পাদনা: আশিক রহমান