আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান গাজিপুর ও টাঙ্গাইলে ১১ জঙ্গি নিহত , আশুলিয়ায় গ্রেফতার ৪
সুজন কৈরী, ছানাউল্লাহ নূরী (গাজীপুর) ও তানজিনুল হক (টাঙ্গাইল): গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পৃথক তিন অভিযানে ১১ জঙ্গি নিহত হয়েছে। অন্যদিকে আশুলিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। র্যাব, পুলিশ ও কাউন্টার টেরোরিজম এবং সোয়াট টিমের সদস্যরা গতকাল শনিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এ অভিযানগুলো চালায়। এর মধ্যে গাজীপুরের হাড়িনাল ও পাতারটেকে র্যাব-পুলিশের পৃথক অভিযানে ৯ ও টাঙ্গাইলে র্যাবের অভিযানে ২ জঙ্গি নিহত হয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইল সদরের কাগমারা মির্জামাঠে র্যাবের পৃথক অভিযানে নিহত হয় ২ জঙ্গি। এদের মধ্যে তিনজনের নাম জানিয়েছে পুলিশ। এরা হলোÑ নব্য জেএমবির ঢাকা বিভাগের সামরিক শাখার কমান্ডার ফরিদুল ইসলাম আকাশ, তৌহিদুল ইসলাম এবং রাশেদ মিয়া।
গতকাল সকাল থেকে বিকাল সোয়া তিনটা পর্যন্ত গাজীপুরের নুয়াগাঁওয়ের পাতারটেকের একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ‘অপারেশন শরতের তুফান’ নামক অভিযান চালায় পুলিশ। এই অভিযানে ৭ জঙ্গি নিহত হয়। বগুড়া পুলিশের দেওয়া তথ্যে এ অভিযানগুলো পরিচালনা করা হয়। অভিযানে অংশ নেয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি বিভাগ, গাজীপুর জেলা পুলিশ, বম্ব ডিস্পোজাল টিম ও সোয়াট টিমের সদস্যরা। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসও অভিযানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
পুলিশ জানায়, আকাশ তার সঙ্গীদের নিয়ে পাতারটেকে দোতলা একটি বাড়িতে অবস্থান করছে- এমন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল সকালে অভিযান চালায় পুলিশের সিটিটিসি ও সোয়াট ইউনিটের যৌথ দল। অভিযানের প্রথমে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। বিশ্বাস অর্জনে জঙ্গিদের কক্ষের ভেতরে পানির বোতলও পাঠানো হয়। কিন্তু তারা পুলিশের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পাল্টা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ও গ্রেনেড ছোড়ে। এছাড়া বাসার দরজার সামনে জঙ্গিরা এলপি গ্যাস সিলিন্ডার রেখে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। পরে আশপাশের বাসা-বাড়ি ও রাস্তা থেকে এলাকাবাসীকে সরিয়ে নেয় পুলিশ। এরপর ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে ভিতরে পানি দেয়। পরে মূল অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। বিকাল সোয়া তিনটা পর্যন্ত থেমে থেমে জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের গুলি বিনিময় হয়। এতে ৬ সহযোগীসহ আকাশ নিহত হয়। এ সময় পুলিশের এক সদস্য আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে তিনটি বিদেশি অস্ত্র, বেশকিছু চাপাতি ও একটি গ্যাস সিলিন্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। গোলাগুলির মধ্যে ১৪টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছে। জঙ্গিদের লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। নিহতদের নাম-ঠিকানা ও পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। সিটিটিসির এডিসি মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন জানান, ভিতরে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ অন্যান্য আলামত উদ্ধারে কাজ চলছে। কিছু আলামত ও ডকুমেন্টস জঙ্গিরা নষ্ট করে দিয়েছে। এদিকে এই অভিযানের আগে এক কিলোমিটারের মধ্যে গতকাল গাজীপুরের পশ্চিম হাড়িনালের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় একে-২২ রাইফেল, একটি নাইন এমএম পিস্তল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, চাপাতি ও বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি। অভিযান শেষে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ অভিযান চালানো হয়েছে। নিহত দুই জঙ্গির প্রাথমিক পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেনÑ রাশেদ মিয়া ও তৌহিদুল ইসলাম। তাদের বাড়ি নরসিংদীতে। তবে বাড়ির মালিক আতাউর রহমানের কাছে থাকা ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম অনুযায়ী এ তথ্য জানা গেছে। তবে এই তথ্য সঠিক কিনা তা এখনো যাচাই-বাছাই চলছে। মুফতি মাহমুদ জানান, বাড়িওয়ালাকে রাশেদ মিয়া জানিয়েছিল সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে পরীক্ষা দিয়েছে কিনা সে ব্যাপারে বাড়িওয়ালা নিশ্চিত নন। আর আতাউর রহমান গাজীপুরের জয়দেবপুরের ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (ডুয়েট) ছাত্র ছিল। অপরদিকে গতকাল সকালে টাঙ্গাইলের কাগমারায় মির্জাবাড়ির মাঠের কাছে তিনতলা একটি ভবনে পৃথক জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে র্যাব। এ সময় জঙ্গিদের সঙ্গে র্যাবের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। এছাড়া র্যাবের দুই সদস্য আহত হয়েছেন।
গতকাল বিকাল চারটায় টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১২ এর কমান্ডার ও এডিশনাল ডিআইজি শাহাবুদ্দিন খান জানান, ওই আস্তানা থেকে একটি পিস্তল, একটি রিভলবার, ১০টি চাপাতি, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দুটি ল্যাপটপ ও নগদ ৬৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি জানান, অভিযানের শুরুতে ভবনটি ঘিরে ফেলা হয়। এরপর ঢাকা থেকে বম্ব ডিস্পোজাল টিমের সদস্যরা পরে ভবনের ভিতরে প্রবেশ করে। এ সময় জঙ্গিরা গুলি ছুড়লে র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়ে। এতে দুই জঙ্গি নিহত হয়। তবে তাদের পরিচয় কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। তিনি জানান, কাগমারা মির্জা মাঠের পাশে আজাহার আলী মাস্টারের বাড়িতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর জঙ্গিরা বাসা ভাড়া নেয়। সারাদেশব্যাপী জঙ্গি অভিযান চলমান থাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানতে পারে ওই বাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় তাদের কার্যক্রম চলছে। বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে র্যাবের সদস্যরা সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় আল্লাহ হু আকবর ধ্বনি দিয়ে জঙ্গিরা র্যাবের উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। র্যাবও পাল্টা গুলি চালালে দুই জঙ্গি নিহত হয়। বাসার মালিক আজাহার উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, প্রথমে তিনজন ছাত্র বাসা ভাড়া নেয়। তাদের কাছে পরিচয়পত্র চাইলে দু-একদিনের মধ্যেই দেওয়ার কথা বলে ওই ছাত্ররা। এ ঘটনার পর তিনি জানতে পারেন তারা জঙ্গি কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত।
অন্যদিকে আশুলিয়ায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে এক বাড়িতে র্যাব-৪ এর অভিযান চালিয়ে বাড়ির কেয়ারটেকারসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল শনিবার বিকালে আশুলিয়া বাইপাইলের বসুন্ধরাটেক এলাকার মৃধা ভিলা নামে একটি পাঁচতলা ভবনে অভিযান চালানো হয়। আটক চারজনের মধ্যে একজন বাড়ির মালিক আমির মৃধা শাহিনের শ্যালক তারেক। তিনি বাড়িটি দেখভাল করেন। এছাড়া বাকিদের নাম নাম জানা যায়নি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে র্যাবের চারটি গাড়ি ওই বাড়ি ঘিরে অবস্থান নেয়। এ সময় প্রথমে তারেককে আটক করা হয়। এ সময় এক যুবক বাড়ির পঞ্চম তলা থেকে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে র্যাব তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। উল্লেখ্য, শনিবার দুপুর ২টার দিকে আশুলিয়ার পলাশবাড়ি এলাকা থেকে এক যুবককে জঙ্গি সন্দেহে ধরে নিয়ে যায় র্যাব ও পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক র্যাব এ অভিযান চালায়। সম্পাদনা: আজাদ হোসেন সুমন