জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সাফল্য
মিল্টন বিশ্বাস
১ জুলাইয়ের (২০১৬) হলি আর্টিজানের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর বর্তমান সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী অবস্থান মানুষের মনে স্বস্তি এনেছে। বিশেষত কল্যাণপুর, আজিমপুর, গাজীপুর এবং দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে শীর্ষ নেতারা নিহত হওয়ায় তাদের পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। উপরন্তু সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশকিছু জঙ্গি সদস্য আত্মসমর্পণ করেছে। কেবল আইনি প্রক্রিয়া নয়, ধর্মীয় উগ্রবাদিতা নির্মূলে সামাজিক প্রতিরোধের নানান কর্মসূচি গ্রহণের ফলে শেখ হাসিনা সরকারের ওপর জনগণের আস্থা বেড়েছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারতও বলা শুরু করেছে, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতি থাকলে, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হলে, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ মুক্ত থাকলেÑ আমরা স্বস্তি পাই। কারণ সে পরিবেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে ভারতে কিংবা আশপাশের দেশে নাশকতা চালানোর সুযোগ পায় না।’
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়েছে এবং বাংলাদেশের আপামর মানুষ এখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার বলে মত দিয়েছেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আবহমান বাংলা সবসময়ই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। এ সেদিন পর্যন্ত অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকা-ের আগেও এদেশে জঙ্গিবাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসন-কালোত্তর টানা ২১ বছর সামরিক শাসকদের মদদে দেশের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদের জন্ম হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার ক্ষমতায় এলে পটভূমি পাল্টে যায়। মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জঙ্গিরা তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসীন হলে জঙ্গিরা গা ঢাকা দেয়। আত্মগোপনে থাকা এসব জঙ্গি ও জঙ্গি সংগঠন বর্তমান সরকারের সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে আবারও মাথা তোলার চেষ্টা করে। আর সংগঠনগুলোর সব একই নেটওয়ার্কে অর্থাৎ হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি)-এর কার্যক্রম অনুসরণ করে নাশকতার বিস্তৃত কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছে।
১৯৯২ সালে আফগান-ফেরত মুজাহিদদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু হয়। তাদের অনুসৃত পথে এখন শতাধিক জঙ্গি সংগঠন রয়েছে দেশে। নেতৃত্বে আছে আফগান-ফেরত মুজাহিদদের কেউ না কেউ। বরগুনা থেকে ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট গ্রেপ্তারকৃত ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সদস্যরা সংগঠিত হচ্ছিল হুজির সাবেক নেতা ও ফাঁসিতে মৃত্যুবরণকারী শায়খ আবদুর রহমানের আদর্শে। মূলত হুজির পূর্বসূরিদের ‘সশস্ত্র বিপ্লব’-এর মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের ‘অসম্পন্ন’ কাজ সম্পন্ন করতে নেমেছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায়, জঙ্গিদের কার্যক্রম প্রায় কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য বিভিন্ন সময়ে নাশকতার সৃষ্টি করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করছে তারা। তারা হেফাজতের সঙ্গে মিশেও সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিল; ব্যর্থ হয়ে নিজেরা নাশকতার ছক তৈরি করছে দেশজুড়ে। উল্লেখ্য, আফগান-ফেরত কয়েক হাজার মুজাহিদ আলাদা আলাদা সংগঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর কার্যক্রমে জড়িত রয়েছে। হুজি, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ ও আনসারুল্লাহর নীতি ও আদর্শ একই।
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসীন হয়ে গত সাড়ে সাত বছরে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর দিকে অগ্রসর হয়েছে। এ সময় সরকার ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং বামপন্থি সর্বহারাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে। কিন্তু ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হলে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির দেশে অরাজকতা ও নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। অন্যদিকে, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটলে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় নিষিদ্ধ ঘোষিত কিছু জঙ্গি সংগঠন। এদের সকলের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো। ফলে গত মহাজোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও, তাদের কারণে খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
২০১২ সাল পর্যন্ত সরকারকে ১৮টির মতো সন্ত্রাসী কর্মকা- মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর মধ্যে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে মারা পড়েছে ৪৬ জন। ৩৫টির মতো ইসলামী দলের নাশকতা ব্যর্থ করেছে পুলিশ-র্যাবের যৌথবাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৬১৬ জঙ্গিকে যারা হুজি, ইসলামী ছাত্রশিবির, জেএমবি, হিযবুত তাহরির ও হিযবুত তাওহিদের সদস্য। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ইসলামী নেতাদের মুক্ত করার জন্য দেশব্যাপী যে নাশকতার সৃষ্টি করা হয় সে পরিস্থিতিতে আরও বেশকিছু শিবিরকর্মীকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় পুলিশ। এক হিসেবে, ২০১২ সাল পর্যন্ত ৭৭টি নাশকতার ঘটনায় ১২৪৪ জন ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূলত ইসলামী জঙ্গি গ্রেপ্তারে সাফল্য রয়েছে অনেক। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ২০১২ সালের ১৯ নভেম্বর পুলিশ ছাত্রশিবিরের ১০৭ ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে ৬ নভেম্বর একই অভিযোগে সারাদেশ থেকে ২০৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৩ সালের মতোই ২০১২ সালের ২১ অক্টোবর র্যাব বরগুনা থেকে হিযবুত তাহরিরের ৮ ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করে। সে বছরের ১২ আগস্ট ব্যাপক নাশকতার পরিকল্পনা করার জন্য মিটিংয়ে বসলে ঢাকার পান্থপথের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে হিযবুত তাওহিদের ৩৫ ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করার চেষ্টা করলে কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে র্যাব ও পুলিশ গ্রেপ্তার করে কয়েকজনকে। এদের মধ্যে কেবল হিযবুত তাওহিদ নয়, জেএমবির নেতারাও রয়েছে।
২০১২ সালের ৫ মার্চ র্যাব খুলনা ও সাভার জোনের দুই প্রধান জেএমবি নেতাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। এর আগে ঢাকার উত্তরা থেকে ৯ জানুয়ারি জেএমবি নেতা বাংলা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ এমদাদুল হক উজ্জ্বলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ প্রশাসন। জেএমবির অর্থ লেনদেনের প্রধান তাহা মোহাম্মদ ফাহিমকে সঙ্গীসহ গ্রেপ্তার করা হয় একই মাসের ৮ তারিখে। চৌদ্দজন নেতাসহ ৩৪ জন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট সর্বহারাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে যেমন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- নির্মূল করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের নাশকতা ও জঙ্গিপনার জবাব দিতে হচ্ছে সরকারকে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান