সাভার বেদেপল্লি ও গুড পুলিশিং…
রহমান শেলী
সমাজ বা দেশ এগিয়ে যাওয়া মানে কী? এর উত্তর খুঁজলে পাব সাভার বেদেপল্লির উদাহরণ। আমরা যাদের চিনি ‘সিঙ্গা লাগাই, ফু লাগাই, বাত ছাড়াই বা পোকা ছাড়াই’ গোষ্ঠীর লোক হিসেবে। তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি অবহেলিত অংশ। গ্রামাঞ্চলে লোকেরা বলে বাইদ্দা। এ বাইদ্দা জনগোষ্ঠী যে আমাদের সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষজন তা ভাবিনি কখনও। তারা যে সিঙ্গা লাগানো নামে পুরাটাই মিথ্যে আশ্রয় নিয়ে থাকে তা আমরা ভাবিনি। কানের পোকা ছাড়ানোর নামে যে নিজেরাই পোকা সংগ্রহ করে, আমার-আপনার কান থেকে পোকা বের করত তা ভাবিনি। দাঁত গেল গেল করে চিৎকার করে কান ফাটানোর পর বেদের মিথ্যে ফুকে বলেছি, এখন ভালো লাগছে!
এই বেদেরা চলছে মিথ্যের আশ্রয়ে। এক অজানা কুসংস্কারের ভিতর দিয়ে। তারপর আমরা যখন কেউ কেউ সচেতন হলাম, তখন সিঙ্গা লাগানো বাদ দিলাম। আর ওরা তখন বেছে নিল মাদক ব্যবসাকে। কেউ কেউ এখনও জীবিকার তাড়নায় ফুকাফুকিতেই আছে। কেউ আবার সাপের খেলায় বাজিমাত করছে। রাস্তাঘাটে আমরা এর মুখোমুখি হয়েছি বহুবার। যেখানে আমরা ভাবছি, দেশ এগোচ্ছে! সমাজ এগোচ্ছে! সেখানে কীভাবে একটি জনগোষ্ঠী ছলচাতুরি বা মিথ্যেকে ভর করে এগোচ্ছে?
সাভার বেদেপল্লি ইতোমধ্যে সবার নজর কেড়েছে। এখানে বেদেরা স্বীকার করেছে, এরা হয় ঝাড়-ফুক করছে না হয় মাদক ব্যবসা করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করছে। সেখানে নজর দিলেন, এসপি হাবিবুর রহমান। গড়ে তুললেন, সামাজিক সহযোগিতা। বেদে মহিলাদের জন্য সেলাই মেশিন দিলেন। বেদেপল্লি থেকে গার্মেন্টসপল্লি হলো। মিথ্যের আশ্রয় থেকে সত্যের চিরকল্যাণকর পথ হলো। সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ হয়। তার নাম হয়, হাবিবিয়া মসজিদ। ওরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভোলেনি। কারণ, তাদের জন্য মায়াকান্নাটা হাবিবুর রহমানই কেঁদেছেন। তিনি এডিশনাল ডিআইজি হলেন। ঢাকা জেলা থেকে চলে গেলেন নতুন জায়গায়। তার মানে কী তিনি ভুলে গেলেন, সবকিছু! কেউ কেউ ভুলে যান।
চাকরির খাতিরে অনেকে অনেক কিছু করেন। লোক দেখানো, সমাজ দেখানো মানুষজন এ সমাজে কম নয়। তিনি পদোন্নতি পেয়ে বড় পদ পেলেন। যত উপরে যান না কেন, তিনি ভুলে যাননি। কেউ আসলে বড় হয় না, বড় দেখায়। বড় দেখানো বা বড় হওয়ার মাঝে হারিয়ে যাননি। থাকেন অবহেলিত, অশিক্ষিত ও দুঃখ-কষ্টের মানুষগুলোর সঙ্গে। ৮ অক্টোবর বেদেপল্লির তিনজন পাত্রীর বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। এরা পূর্বে বাল্যবিবাহের পথে পা দিয়েছিল। সেখানেও হাত লাগালেন তিনি। বললেন, সরকারের আইনকে মান্য করা উচিত! উন্নয়নে একটা বড় বাধা বাল্যবিবাহ। তিনি এবং সমাজের বিশিষ্টজনেরা থেকে মহাধামাকায় সানাই বাজিয়ে সেই তিনজনের বিয়ের আয়োজন হয়েছে। টিভি এবং বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা দেখেছি। বিষয়টা আমাদের সবারই ভালো লেগেছে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ভালো লাগাটা হতো না, যদি না তিনি এগিয়ে আসতেন। হাবিবুর রহমান স্যার যদি শুধু পুলিশিংই করতেন তাহলে এ কাজ হতো না। এ মহা আয়োজন হতো না। এটাকে বলা যেতে পারে ‘গুড পুলিশিং’। কিংবা বলতে পারি, আউট অব দ্য বক্স! নিজের কাজ ছাড়াও সমাজটাকে দেখা! বলতে পারি, কিছু করা! এ উদ্যোগ দেশের মানুষকে সচেতন করবে, উৎসাহিত করবে কোনো সন্দেহ নেই। কেউ কেউ নিজের চেয়েও অন্যেকে বেশি সময় দেবে, সহযোগিতার হাত বাড়াবে।
আমরা জাগলেই তো দেশ জাগবে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বিশ্বদরবারে। রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ দুনিয়ার মানুষের কাছে মডেল হবে, গর্বিত নাগরিক হবো আমরা। আমাদের আন্তরিক প্রয়াস, জগৎজয়ের আশার মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে প্রত্যাশিত গন্তব্যের দিকে। এমনটিই তো চাই আমি, আপনি, আমরা। আন্তরিক চাওয়ার পূর্ণতা সুনিশ্চিত বলেই বিশ্বাস করি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও এডিশনাল এসপি
সম্পাদনা: আশিক রহমান