নির্বাচন কমিশনে নিয়োগে রাষ্ট্রপতির নিজ ইচ্ছায় কিছুই করার নেই
ইকতেদার আহমেদ
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত। সংবিধানে যদিও উল্লেখ রয়েছে নির্বাচন কমিশনবিষয়ক আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করবেন কিন্তু অদ্যাবধি নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণীত হয়নি।
সংবিধানের অধীন নির্বাচন কমিশন যে সকল দায়িত্বপালন করে থাকে তা হলোÑ (ক) রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান; (খ) জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান; (গ) জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতি পদের এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ। উপরোক্ত দায়িত্বের বাইরে বিভিন্ন নির্বাচনি আইনে নির্বাচন কমিশনকে বিভিন্ন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যেমনÑ জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ প্রভৃতির নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির উর্ধ্বে স্থান লাভ করলেও সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি পদটি অলঙ্কারিক। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সকল দায়িত্বপালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করবেন। উপরোক্ত দুটি নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি তার নিজ ইচ্ছায় যে কাউকে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন না। রাষ্ট্রপতি তাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদান করেন যিনি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বিষয়ে সংবিধানে পৃথকভাবে কোনো যোগ্যতার উল্লেখ না থাকলেও সচরাচর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পেয়ে আসছেন এবং বাংলাদেশে অদ্যাবধি আপিল বিভাগের বিচারক পদে কর্মরত নন এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সুতরাং রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগদান করবেন এটা অনেকটা প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ কারণে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সময় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে অতিক্রান্ত করা হলে তা নানাবিধ প্রশ্নের জন্ম দিবে।
কতিপয় সাংবিধানিক পদ যেমন উচ্চাদালতের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, অ্যাটর্নি জেনারেল প্রভৃতির ন্যায় কতিপয় সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মেয়াদি পদ যেমনÑ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য প্রভৃতিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত সকল নিয়োগে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী নিয়োগ সংক্রান্ত কার্য সমাধা করেন। উপরোক্ত কোনো নিয়োগে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে তার নিজ ইচ্ছায় সরকারের প্রধান নির্বাহী তথা প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষার বাইরে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। সাংবিধানিক বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে আইন প্রণীত না হওয়ার কারণে এ সকল নিয়োগ বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের নিমিত্ত আইনগতভাবে সার্চ কমিটি গঠনের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে ইতোপূর্বে একবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিষয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটি গঠনপূর্বক রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রতিটি পদের বিপরীতে দুটি নামের সুপারিশ প্রেরণের জন্য বলা হয়। উক্ত সার্চ কমিটিকর্তৃক সুপারিশ প্রদানের আগে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন এবং উক্ত বৈঠকে কতিপয় রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির নিকট নামের তালিকা প্রদান করেন। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে রাজনৈতিক দলসমূহ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপকালীন কোন কোন নামের তালিকা প্রদান করেছে এবং তদপরবর্তী সার্চ কমিটির সুপারিশে কোন কোন নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল এ বিষয়গুলোর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ যেটি তা হলোÑ এ সকল পদে নিয়োগ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কি পরামর্শ দিয়েছেন। সুতরাং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারসহ অপরাপর সাংবিধানিক পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আইনের অনুপস্থিতিতে নির্বাহী আদেশে সার্চ কমিটি গঠনপূর্বক রাষ্ট্রপতির বরাবর নামের তালিকার সুপারিশে কোন কোন নাম অন্তর্ভুক্ত এটি গৌণ আর এখানে মূখ্য হচ্ছে কোন নামের বিপরীতে প্রধামন্ত্রীর পরামর্শ রয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, সার্চ কমিটি সরকার দ্বারা কোনোভাবে প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে নামের তালিকা প্রস্তুত করেছে, সেক্ষেত্রে কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে নামের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে এ প্রশ্নটি এসে যায়। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সার্চ কমিটির তিনজন সদস্যের সকলেই সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন এ দুটি সংস্থার মেয়াদি পদসমূহে নিয়োগ বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারের নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট এবং আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটি গঠন বিষয় সংস্থাদ্বয়ের আইনে উল্লেখ রয়েছে। উভয় আইনে বলা আছে, সার্চ কমিটি প্রতিটি পদের বিপরীতে রাষ্ট্রপতি বরাবর দুটি নাম প্রেরণ করবেন। উভয় আইনে নিয়োগপ্রাপ্তদের কতিপয় যোগ্যতার বিষয় উল্লেখ থাকলেও তালিকায় অন্তর্ভুক্তরা এ ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন অনেকের মধ্য হতে কি বিশেষ যোগ্যতার ভিত্তিতে স্থান পেলেন এমন প্রশ্ন উদয় হওয়া স্বাভাবিক। এরপরও কথা থাকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত দুজনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি যাকে নিয়োগ দিচ্ছেন তা তিনি নিজ ইচ্ছায় নয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করছেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। মেয়াদপূর্তিজনিত কারণে যে নতুনভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। নতুন নির্বাচন কমিশন যদি আগেকার নির্বাচন কমিশনের ন্যায় নির্বাহী আদেশবলে গঠিত সার্চ কমিটিকর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়, সে নিয়োগকে যতভাবেই স্বচ্ছ বলে দাবির প্রয়াস নেওয়া হোক না কেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতা বিবেচনায় নেওয়া হলে তা অস্বচ্ছতার আবরণে ঢেকে যেতে বাধ্য।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান