২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ চিত্রশিল্পী সুলতানের ভাসমান নৌকা চিত্রায় ভাসানোর দাবি
মো. ইমরান হোসেন, নড়াইল : বোহেমিয়ান সুলতান শিখেছিলেন প্রকৃতির কাছে। তার চিন্তা-ধ্যান সবই ছিল বাংলাদেশের প্রকৃতি আর মানুষকে নিয়ে। জীবজন্তু আর গাছপালায় ঘেরা ছিল তার মাছিমদিয়ার ছোট্ট আবাসভূমি। নিজে না খেয়ে তার পোষা কুকুর বিড়াল আর বানরকে খাইয়েছেন। খ্যাতির শিখরে উঠেও তিনি নড়াইল আর চিত্রা নদী ছেড়ে নগর জীবনে যাননি। মৃত্যুর পর শিল্পীর বাসভবন, শিশুস্বর্গ ও সমাধিস্থল ঘিরে ‘এসএম সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা’ নির্মাণ করা হয়েছে। সুলতানের অঙ্কিত ছবি, ভাসমান শিশুস্বর্গ (নৌকা) ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হন দর্শনার্থী।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর শিল্পীর মৃত্যুর পর তার বাসভবন, শিশুস্বর্গ ও সমাধিস্থল ঘিরে ‘এসএম সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা’ নির্মাণ করা হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মাণকাজ শেষে ২০০৬ সালের অক্টোবরে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এসএম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা। ২০০৯ সালে স্থাপন করা হয় এসএম সুলতান আর্ট কলেজের। যা বর্তমানে এসএম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া সুলতান আর্ট কলেজের পাশেই ‘লালবাউল ও শিশুস্বর্গ-২’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবুজ-শ্যামলে ঘেরা ‘এসএম সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা’র ফুল, পাখি, গাছপালার অপরূপ রূপের আকর্ষণেই প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন পর্যটকরা। মুগ্ধ হন সুলতানের অঙ্কিত ছবি, ভাসমান শিশুস্বর্গ (নৌকা) ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখে। সুলতানের এখানে ছবি আঁকতে পেরে অনেকে আনন্দ পায় বলে জানালো শিশু শিক্ষার্থীরা।
সুলতান সবসময় শিশুদের নিয়ে ভাবতেন। তার স্বপ্ন ছিল শিশুরা যেন প্রকৃতির কাছে থেকে শিখে পরিপূর্ণভাবে মানুষ হয়ে উঠতে পারে সে জন্য সুলতানের আশা ছিল চিত্রা নদীতে একটি বজরায় করে তিনি শিশুদের নিয়ে ভেসে বেড়াবেন। আর শিশুরা মনের আনন্দে ছবি আঁকবে। এই বজরা নিয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে তিনি সুন্দরবন পর্যন্ত যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
সুলতানের এই স্বপ্নের কথা জানতে পেরে তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার জেভিসের সহায়তায় ১৯৯২ সালে শিশুদের জন্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। সুলতান নিজে তদারকি করে বানিয়েছিলেন স্বপ্নের ‘শিশুস্বর্গ’। ৬০ ফুট লম্বা এবং ১৩ ফুট চওড়া ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ বজরা নৌকাটির ভিতরে রান্না -খাবারসহ শিশুরা যাতে নিরাপদে প্রকৃতির কাছাকাছি এসে ছবি আঁকতে পারে তার সব ব্যবস্থাই রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিশুদের নিয়ে বজরায় করে চিত্রানদীতে ভেসে ছবি এঁকে বেড়াতেন।
১৯৯৪ সালে সুলতানের মৃত্যুর পর ২/৩ বছর পানিতে ভেসে থাকলেও অবহেলার এক পর্যায়ে বজরাটি চিত্রানদীতে তলিয়ে যায়। জেলা প্রশাসন নড়াইল সুলতানের ঘাটে একটি ঘর নির্মাণ করে সেখানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সহায়তায় বজরাটি উত্তোলন করে। বজরাটি এখন দেখভালের অভাবে ঘুণে ও উইপোকায় খাচ্ছে ইতো মধ্যে ভেঙ্গে গেছে বজরার কিছু অংশ।
এসএম সুলতান গবেষক ও লোহাগড়া সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তারেক আলম জানান, লোক দেখানো সুলতানপ্রেম না দেখিয়ে সুলতানের ঘাটটি নির্মাণ করে সেখানে ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গের আদলে আরেকটি নৌকা তৈরি করে চিত্রা নদীতে ভাসিয়ে শিল্পীর আদর্শের মর্যাদা দেওয়া উচিত।
সংগ্রহশালাকে পর্যটনবান্ধন ও আকর্ষণীয় করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে এসএম সুলতান ফাউন্ডেশন সভাপতি ও নড়াইল জেলা প্রশাসক মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ জানান, স্থানীয় লোকদের সাথে নিয়ে এসএম সুলতানের বজরাটির আদলে একটি বজরা (ভাসমান নৌকা) বানিয়ে দ্রুত সুলতানে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা হবে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মেছের আলী। মা মাজু বিবি। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এসএস সুলতান। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের কুড়িগ্রামে তাকে শায়িত করা হয়। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম