
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান থমথমে গাজীপুরের পাতারটেক ও লেবুবাগান
সুজন কৈরী, ছানাউল্যাহ নূরী (গাজীপুর) ও তানজিনুল হক, (টাঙ্গাইল): গাজীপুরের পাতারটেক ও পশ্চিম হারিনালের লেবুবাগানে পুলিশ-র্যাবের পৃথক অভিযানে নয় জঙ্গি নিহত হওয়ার পর থেকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। জঙ্গি আতঙ্কে রয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। গত শনিবারের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর বাসিন্দাদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। তারা ভাবতেই পারেছন না যে, পাশে বা একই ভবনে জঙ্গিদের সঙ্গে তারা থাকছেন।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পাতারটেকের বাড়িটিতে চারটি ফ্যাট রয়েছে। যার একটি জঙ্গিরা ভাড়া নিয়েছিল। আর বাকিগুলোতে পরিবার থাকে। বাড়িটি বেশ খোলামেলা। ওই বাড়ির সঙ্গে আর কোনো বাড়ি নেই। বাড়িটির তিন পাশেই নানা ধরনের গাছ রয়েছে। এক পাশে জলাশয়।
এদিকে পাতারটেকে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইলে র্যাবের অভিযানে নিহত দুই জঙ্গির লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। অপরদিকে আশুলিয়ায় র্যাবের অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির অর্থ জোগানদাতা আব্দুর রহমান আইনূলের স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ বিভিন্ন আলামত আশুলিয়া থানায় হস্তান্তর করেছে র্যাব। এ ঘটনায় নিহত জঙ্গির স্ত্রীকে আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া নিহত ওই জঙ্গির লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে।
পাতারটেকের ওই বাড়িটির নিচতলার ভাড়াটিয়া আসমা বেগম বলেন, ঘটনার দিন সকালে সাদা পোশাকে সাত-আটজন লোক এসে বাড়ির উপরে উঠছিলেন। ওই সময় তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তারা উপরে তাদের লোক আছে বলে চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর ওই ব্যক্তিরা নেমে এসে সবাইকে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। এরপরই শুরু হয় পুলিশের অভিযান। তখন আমরা জানতে পারি বাড়ির দোতলার নতুন ভাড়াটিয়ারা জঙ্গি। তিনি বলেন, দুমাস আগে ভাড়াটিয়ারা ওই বাড়িতে ওঠে। তাদের দু-একজনকে মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার দিকে বের হতে দেখা গেছে। রাতে ফেরার সময় ব্যাগের ভেতর শাকসবজি নিয়ে আসতে দেখেছেন। দোতলা থেকে নিচতলায় একদিন ময়লা পানি পড়ার পর উপরে গিয়ে ওদের দরজায় কড়া নাড়েন আসমা। কিছু সময় পর একজন উঁকি দিয়ে দরজা নাড়ার কারণ জানতে চায়। তবে বাসার ভেতরে আসমাকে প্রবেশ করতে দেয়নি। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বাড়ির মালিক প্রফেসর ওসমান গনিকে বিচার দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। আসমা জানান, তিনি বুঝতেই পারেননি, তার বাসার ওপরেই এত দুর্ধর্ষ জঙ্গি থাকতো। অভিযানের সময় পুলিশ বাড়িটি ঘিরে ফেললে তিনি আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তার মতো আশপাশের বাসিন্দারাও আঁতকে ওঠেন। মুহুর্মুহু গুলি আর গ্রেনেডের বিকট শব্দে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায় তাদের। এ আতঙ্ক গতকালও বিরাজ করছিল তার মনে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশের বাড়ির একজন বাসিন্দা জানান, তাদের এলাকায় এত বড় জঙ্গি আস্তানা গেড়েছে তা তারা বুঝতেই পারেননি। বাড়িটির পাশের চা-বিক্রেতা মফিজ উদ্দিন বলেন, বাড়িটি সুলাইমান সরকার সৌদি প্রবাসীর। কিন্তু তার ভাই কালীগঞ্জের জাঙ্গালিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আরবির শিক্ষক ওসমান গণি বাড়িটি দেখাশোনা করেন। ঘটনার পর পুলিশ তাকে আটক করেছে।
অপর ভাড়াটিয়া জুলেখা বেগম জানান, তিনি প্রায় ২০ দিন আগে ওই বাড়িতে ভাড়ায় উঠেছেন। জঙ্গিরা মাঝে মধ্যে বের হলেও কারও সঙ্গে কথা বলতো না।
অভিযানের ১২ ঘণ্টা পর বাড়ির নিচতলা থেকে সন্তানসহ এক মাকে উদ্ধার করে পুলিশ স্বজনদের কাছে নিরাপদে পৌঁছে দেয়। অভিযানের পুরোটা সময় ধরে তিন বছরের সন্তান নুরুন্নাহারকে নিয়ে আয়েশা বেগম নিচতলার ফাটের একটি কক্ষের এক কোনায় ছিলেন। অভিযানের সময় ছোড়া গ্রেনেড ও গুলির ঘটনায় তারা এখনও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। আয়েশা বলেন, অনবরত গ্রেনেড ও গুলির শব্দে তার শিশু সন্তান প্রচ- ভয় পেয়েছে। ঘটনার পর থেকে কোল থেকেই নামতে চাচ্ছে না। গাজীপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সবুর জানান, তারা নিচ তলার একটি ফ্যাটের রুমে ছিলেন। স্বজনদের কাছে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা ভালো আছেন। আয়েশা বেগম বলেন, অভিযানের প্রথমে তিনি তার মেয়েকে নিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলেন। পুলিশের ডাকাডাকি করেছে কিনা শুনতে পাননি। তিনি জানান, তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তার স্বামী সোবহান শেখ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। নিচ তলার পূর্বপাশের ফ্যাটের একটি রুম দুই হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে তার স্বামী থাকেন। তার খালাতো ভাইও স্বামীর সঙ্গে ওই রুমে থাকেন। কয়েকদিন আগে আয়েশা সেখানে বেড়াতে এসেছেন। আয়েশা বলেন, ঘটনার দিন হঠাৎ ১১টার দিকে গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে তার। সঙ্গে সঙ্গে বাসার বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু দরজা বাইরে লাগানো থাকায় বের হতে পারিনি। পরে বিষয়টি ফোনে স্বামীকে জানান তিনি। তার কাছ থেকে শুনি যে, বাড়িতে পুলিশ জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অভিযানের সময় থেমে থেমে প্রচ- শব্দ হচ্ছিল। তখন আমরা মা-মেয়ে কান্না করি আর দোয়া পড়তে থাকি। তখন মনে হচ্ছিল, ভবনটি ভেঙ্গে মাথায় পড়বে। ভয়ে সারাদিন রুমের এক কোনায় গিয়ে বসেছিলাম। আমি এমন ভয় আর কখনো পাইনি। তিনি বলেন, যতদিন বাড়িটিতে থেকেছি; কখনও বুঝতে পারিনি যে, এখানে এত জঙ্গি আছে।
ওই বাড়ির নিচতলার ফ্যাটের একটি কক্ষের অপর ভাড়াটে জাহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। বাড়িটির দ্বিতীয় তলার পূর্ব পাশের ফ্যাটটি দুমাস আগে ওরা ভাড়া নেয়। তবে তাদের খুব কমই দেখা যেত। তারা বাসা থেকে বের হতো কম। শুক্কুর নামে ওই বাড়ির আরেক ভাড়াটিয়া বলেন, আমি পিকআপ ভ্যান চালাই। গত কদিন আগে দোতলার ফ্যাটের সামনে একজোড়া স্যান্ডেল দেখে বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, দোতলার পূর্ব পাশের ওই ফ্যাটটি ভাড়া হয়েছে কিনা? তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, ভাড়া হয়েছে। তবে আমি ভাড়াটিয়াদের কখনও দেখিনি।
অভিযান শেষে পাতারটেক এলাকার গণ্যমান্য পাঁচ ব্যক্তিকে জঙ্গিদের লাশ দেখায় পুলিশ। তাদের মধ্যে দুজন হলেনÑ আলফাজ উদ্দিন পলাং ও মোহাম্মদ আলী। আলফাজ উদ্দিন পলাং বলেন, পুলিশ লাশগুলো আমাদের দেখিয়েছে। তবে কাউকেই আমরা চিনি না। এর আগেও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। তার মতো একই কথা জানালেন মোহাম্মদ আলীও। বাড়িটির সামনের সড়কেই নানা-নাতি নামক একটি মুদি দোকানের মালিক মফিজ মিয়া বলেন, পুলিশ অভিযান চালানোর পর তারা জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি জানতে পারেন। এর আগে এ বিষয়টি বুঝা যায়নি।
পাতারটেকের অভিযানের ঘটনায় মামলা : পাতারটেকে সাত জঙ্গি নিহতের ঘটনায় গতকাল রোববার দুপুরে পুলিশ বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় একটি মামলা (নং-৩৭) দায়ের করেছে। মামলায় নিহত জঙ্গি ফরিদুল ইসলাম আকাশের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। জয়দেবপুর থানার খন্দকার রেজাউল হাসান সন্ত্রাস দমন আইনে এ মামলাটি দায়ের করেন। একই থানা এলাকার হাড়িনালের লেবুবাগানে র্যাবের চালানো অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত হয়। গতকাল রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ওই ঘটনায় মামলা হয়নি। তবে প্রক্রিয়াধীন থাকার কথা জানিয়েছেন ওসি রেজাউল।
ডুয়েটের ছাত্র নয় তৌহিদুল : লেবুবাগানে র্যাবের অভিযানে নিহত জঙ্গি তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) শিার্থী নয় বলে জানিয়েছেন ডুয়েট কর্তৃপ। গতকাল রোববার ডুয়েটের সহকারী পরিচালক, (পরিচালক, গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তর) মোছা. কামারুন নাহার স্বারিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। ডুয়েটের একাডেমিক শাখা থেকে বর্তমান ছাত্রদের নথি ঘেঁটে তৌহিদুল ইসলাম নামে যে সাতজন ছাত্র পাওয়া গেছে তাদের কারও বাড়িই নরসিংদী নয়।
টাঙ্গাইলে দুই জঙ্গির লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন : টাঙ্গাইলে র্যাবের অভিযানে নিহত দুই জঙ্গির লাশের ময়নাতদন্ত টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সম্পন্ন হয়েছে। টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজের আবাসিক চিকিৎসক সাইফুর রহমান খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত মামলা হয়নি।
আশুলিয়ায় অভিযানের ঘটনায় দুই মামলা : আশুলিয়া প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, গত শনিবার র্যাবের অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির নাশকতার মূল অর্থ জোগানদাতা আব্দুর রহমান আইনূলের স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ বিভিন্ন আলামত আশুলিয়া থানায় হস্তান্তর করেছে র্যাব-৪। এ ঘটনায় নিহত জঙ্গির স্ত্রীকে আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে র্যাবের প থেকে হুমায়ন আশুলিয়া থানায় অস্ত্র ও সন্ত্রাস দমন এবং বিস্ফোরক আইনে মামলা দুটি করেন। প্রাথমিকভাবে শাহনাজ আক্তার রুমির জঙ্গির সাথে সম্পৃক্ততা থাকায় তার বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়। র্যাব ৪-এর নবীনগর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মাসুদুর রহমান জানান, আশুলিয়ার বাইপাইলে জঙ্গি আস্তানা থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, বিস্ফোরকসহ গুরত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করা হয়েছে। সেখান থেকে জঙ্গি কার্যক্রমের মূল অর্থ জোগানদাতা আব্দুর রহমান, স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রুমি ও তার তিন সন্তানকে র্যাব আটক করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রুমির জঙ্গির সাথে সম্পৃক্ততা থাকার তথ্য পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবদ শেষে রুমিকে আশুলিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে তাকে আসামি করে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বাড়ির পর্যবেক তারেককে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়া নিহত আব্দুর রহমানের লাশ ঢামেক মর্গে পাঠানো হয়েছে।
