অসাম্প্রদায়িক মানস ও সার্বজনীন শারদীয় বাঙালি উৎসব
বাহালুল মজনুন চুন্নু
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বাঙালি অসাম্প্রদায়িক এক জাতি। চর্যা থেকে আজকের বাংলাদেশ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষের একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এই জাতি। সারা বিশ্বজুড়ে যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে মানুষের মাঝে মানবতা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, সংহতি ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ প্রশ্নবিদ্ধ তখনও বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে অসাম্প্রদায়িকতার নজির স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে। বাঙালির মননে রোপিত অসাম্প্রদায়িক মানসিকতাই এর ভিত্তিমূল। যেহেতু বাংলার প্রকৃতি সাম্প্রদায়িকতাকে স্বীকার করে না সেহেতু বাঙালি মানসে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিরাজ করে আসছে আবহমান কাল ধরেই। আর এই কারণেই নানা ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় কর্মকা- স্বতন্ত্রভাবে পালন করলেও ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে সার্বজনীনভাবে। বাঙালি একটি ভাষাতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা হলেও ধর্মীয় বিভাজন যে এই সমাজে বিদ্যমান তাকে অস্বীকার করা যায় না। তবে সেই বিভাজনকে ম্লান করে দেয় ধর্মীয় উৎসবের সার্বজনীনতা। ঈদ, শারদীয় দুর্গাপূজা, বড়দিন, বৌদ্ধপূর্ণিমা, বৈশাখী ইত্যাদি বাঙালি সমাজের ধর্মভিত্তিক কিন্তু সার্বজনীন উৎসব। শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘনভাবে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ এই উৎসবগুলোকে সার্বজনীনতা দিয়েছে।
মুসলমান সম্প্রদায়ের ঈদ উৎসবের মতোই হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি মাত্রকেই স্পর্শ করে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সকল ধর্মের মানুষই এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে যা এই উৎসবকে সার্বজনীনতা দান করেছে। শরৎকাল মানেই স্নিগ্ধ প্রকৃতি। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ। বিলে-ঝিলে লাল-সাদা শাপলা, নদীর কিনারের সাদা কাশবন পুরো প্রকৃতিকে মনোরম করে তোলে। প্রকৃতির সেই স্নিগ্ধ-কোমল সৌন্দর্যের মাঝেই শারৎদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী সুর বেজে ওঠে। শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝেই যে এই উৎসব শারদীয় শিহরণ জাগায় তা নয়, এই উৎসব সকল বাঙালিকেই উচ্ছ্বল করে তোলে। বাংলায় প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা আরম্ভ হয়েছিল পনের শতকের শেষ ভাগে নদীয়া জেলার তাহিরপুরের জমিদার কংস নারায়ণের রাজবাড়িতে। নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি জাহির করার জন্য তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সভাপ-িত কৃত্তিবাস ওঝা তাকে শারদীয় দুর্গোৎসব পালনে প্ররোচিত করেন। কৃত্তিবাস ওঝার কথামতো তিনি সেই সময়ে আটলাখ টাকা পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে মহাধুমধামে চারদিনব্যাপী সেই উৎসব পালন করেন। ক্রমে এদেশের বৃত্তবান হিন্দু জমিদার ও প্রতিপত্তিশালীদের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও এই উৎসব পালন শুরু করে। আবহমান কাল ধরে বাঙালি জাতির চেতনায় অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা বিরাজ করায় এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে সমাজের সর্বস্তরের জনগণ। আর তাই বিগত কয়েক শতকে এই উৎসব হিন্দু সমাজের গ-ি ছাড়িয়ে সমগ্র বাঙালির সার্বজনীন উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
ঈদোৎসবের মতোই শারদীয় দুর্গোৎসব সমাজকে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করে মানুষের মধ্যে ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে সমগ্র বাঙালিকে। এই উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা। এই উৎসব সমাজে ন্যায়বিচার, সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, সব মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও অন্যায় অবিচার দূরীকরণে উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন ধর্মালম্বী বাঙালির বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব যৌথভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে পালন বাঙালি যে শান্তিপূর্ণ জাতি সেই বিষয়টিকেই প্রকাশ করে থাকে। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই চেতনাকে ধারণ করে বাঙালি মাত্রই সকল ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করে যা তাদের ঐক্যবদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ঈদোৎসব, দুর্গোৎসব, বড়দিন, বৌদ্ধপূর্ণিমাসহ সকল ধর্মীয় উৎসবে সর্বস্তরের মানুষ সব ধরনের হীনতা, সংকীর্ণতা ও ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে আনন্দে মেতে ওঠে। দুর্গোৎসবে পূজোর ধর্মীয় অংশটুকু হিন্দুদের। কিন্তু মেলা, উৎসব-আনন্দ, আপ্যায়নের অংশটুকু সকল বাঙালির। আর একারণেই শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, এই উৎসব বাঙালির উৎসব।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথমভাগের ২ (ক) তে বলা হয়েছেÑ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালন রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সকল ধর্মালম্বী মানুষের সমানভাবে ধর্ম পালন করার অধিকার। আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, খ) রাষ্ট্রকর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে। আবার সংবিধানের ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদেও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এভাবেই সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান ধর্র্মনিরপেক্ষতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়বস্তুকে অর্ন্তভুক্ত করার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করেছিলেন, অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছিলেন।
কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক সরকার সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিকে বাদ দিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় আর সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশকে দূরে সরিয়ে নেয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াতে জোট সরকারের ছত্রছায়ায় দেশে বিস্তার করে হরকাতুল জিহাদ, বাংলাদেশ জামিয়াতুল মুজাহিদিন, হিজবুত তাহরির, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ বিভিন্ন মৌলবাদি জঙ্গিগোষ্ঠী। এরা জঙ্গিবাদী তৎপরতার মাধ্যেমে এদেশের অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্যকে নষ্ট করতে সচেষ্ট ছিল।
ধর্মীয় গোঁড়ামিকে আশ্রয় করে এরা এদেশের হাজার বছরের সম্প্রীতির বন্ধনকে নষ্ট করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু বাঙালির সম্প্রীতির বন্ধন এতই দৃঢ় যে, তারা শত চেষ্টা করেও তাতে কোনো ফাটল ধরাতে পারেনি। অসাম্প্রদায়িক মানস এত গভীরভাবেই বাঙালির মনে প্রোথিত যে, তারা কোনোভাবেই সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনরায় অর্র্ন্তভুক্ত করে। কিন্তু স্বার্থান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি-জামায়াতের কূটকৌশল এখনও পুরোদমে চলছে। তারা এই সুন্দর শান্তিময় অসাম্প্রদায়িক দেশের ওপর সাম্প্রদায়িক দেশের কালিমা লেপনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু যতই ষড়যন্ত্র করুক এদেশে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দিতে তারা পারবে না।
বিশ্বজুড়েই পাশবিকতার উন্মাদ নৃত্য চলছে। সাম্প্রদায়িকতার করাল থাবায় মানবতা বিপর্যস্ত। বাংলাদেশেও এর কিছুটা আঁচ যে লাগেনি, তা অস্বীকার করা যায় না। তবে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও শেখ হাসিনার নির্দেশ ও পরামর্শ মোতাবেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে জঙ্গি দমন করে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার রোধে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা পালন করেছে। শারদীয় দুর্গাপূজোয় যেন কোনোরকম বিঘœ সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সরকার নিশ্চিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে। তাছাড়া বিভিন্ন পূজোম-পে মুসলমান যুবারাও স্বেচ্ছায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের এই উদ্যোগই প্রমাণ করে এই দেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এদেশে মানুষে মানুষে ধর্ম আলাদা হলেও ধর্মীয় উৎসব সার্বজনীন। তাই শরতের স্নিগ্ধ প্রকৃতিতে সার্বজনীন দুর্গোৎসবের আগমনী সুর বেজে উঠলে বাঙালি মাত্রই উল্লাসিত হয়ে ওঠে, হৃদয়ে বেজে ওঠে আনন্দের ঢঙ্কা। এটাই প্রমাণ করে এই উৎসব নিছক হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, এই উৎসব বাঙালির। লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সম্পাদনা: আশিক রহমান