ইসলামে মায়ের প্রতি ভালবাসা!
হুমায়ুন আইয়ুব
মায়ের ভালবাসার কোনো উপমা নেই। নেই মায়ের ভালবাসার কোনো দিবস। মা মধুর, চিরকালই মধুর! মা আদুরে, মা-ই পৃথিবীতে ভালবাসার শ্রেষ্ঠ উপমা। ইসলামের মহান নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন এতিম। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। জন্মের মাত্র চার বছর পরই নিভে যায় আমেনা মায়ের প্রদীপ। পরিণত বয়সে দুধ মা হালিমাকে গায়ের চাদর বিছিয়ে দিতেন নবীজি। ঘরের খাদেম বৃদ্ধ উম্মে আয়মানকে নবীজি মা বলে ডাকতেন। হিজরতের পর মরু আরবের বহু পথ মাড়িয়ে উম্মে আয়মান মদিনায় এলে নবীজি সব কাজ ফেলে বৃদ্ধ মা উম্মে আয়মানের সেবায় লেগে যান। চোখ-মুখের পানি মুছে দেন। পা টিপে দেন। উম্মে আয়মানের কাছে মা আমিনার কথা শুনে মাকে দেখা! মায়ের সঙ্গে কথা বলা; আর মায়ের সেবার কত স্বাদ আহ্লাদ জন্মেছে নবীজির মনে। কিন্তু এই মায়ের অমূল্যধন আগেই হারিয়েছেন তিনি।
সেই অন্ধকারযুগে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনিই মা জাতিকে মর্যাদার সিংহাসন দিয়েছেন। হজরত আবু উমামা রা. বলেন, মহানবী (সা.)কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল সা.! সন্তানের ওপর মা-বাবার কি অধিকার? মহানবী (সা.) বললেন, মা-বাবা তোমাদের জান্নাত অথবা মা-বাবাই তোমাদের জাহান্নাম। ইবনে মাজাহ
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকি শরিফ, নাসায়ি শরিফ)।
কুরআন শরিফে মা!
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমার রব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, তোমরা কেবল তারই ইবাদত করবে এবং মা-বাবার সঙ্গে সুব্যবহার করবে। যদি তাদের মধ্যে একজন কিংবা দুজনই বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে যায়, তাহলে (তাদের খিটখিটে ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে) তাদের তুমি উহফ্ শব্দও বলবে না এবং তাদের ধমকও দিবে না। আর তাদের সঙ্গে তুমি সম্মানজনক কথা বলবে এবং তাদের জন্য দোয়ার মধ্য থেকে নম্রতার বাহু ঝুঁকিয়ে দাও। আর তাদের জন্য দোয়াস্বরূপ এ কথা বলবে- হে আমার রব, তাদের দুজনের ওপর এমন দয়ার আচরণ করো। যেমন তারা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে। (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)।
মহান আল্লাহ মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ভালবাসার আরও বিস্তর বিবরণ দিয়েছেন কুরআনে।
বলেছেন, ‘আর স্মরণ কর, যখন আমি বনি ইসরাইলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করবে না এবং মা-বাবার সঙ্গে উত্তম আচরণ করবে, আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও অসহায়দের সঙ্গেও। (সুরা বাকারা: ৮৩)।
কুরআন আরও বলছে, তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, আল্লাহর সঙ্গে কোনো শরিক কর না। আর সদ্ব্যবহার কর মা-বাবার সঙ্গে। (নিসা: ৩৬)।
কুরআন আরও বলছে, আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুবছরে; সুতরাং আমি আল্লাহ এবং তোমার মা-বাবার কৃতজ্ঞতা আদায় কর। (সুরা লোকমান : ১৪)
হাদিস শরিফে মা!
ইসলামের জীবন সৌন্দর্য্য বরাবরই মানুষকে মুগ্ধ করে। মা-বাবার জন্যও নবীয়ে আরবি (সা.)-র কথাও উম্মতের হৃদয়ে আবেগের ঢেউ তোলে। মা-সন্তানের বন্ধন গভীর করে। মায়ের জন্য নবীজির মূল্যবান উপদেশ শুনে আমরা প্রাণীত হই।
সাহাবি ইবনে মাসউদ বলেন, একবার আমি হজরত নবী করিমকে (সা.)কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন কাজটা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়? তিনি বললেন, সঠিক সময়ে নামাজ পড়া। আমি বললাম, তারপর? তিনি বললেন, মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার। আমি বললাম, তারপর? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি মহানবীকে জিজ্ঞেস করলেন, কে আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার? নবীজি বললেন, তোমার মা! লোকটি জানতে চাইল, তারপর কে? নবীজি বললেন, তোমার মা!
লোকটি আবার জানতে চাইল, তারপর কে? নবীজি বললেন, তোমার মা। লোকটি চতুর্থবার জানতে চাইলেন তারপর কে? নবীজি বললেন, তোমার বাবা! বুখারি, মুসলিম
মা-বাবার জন্য ব্যয়ও ইবাদত!
শুধু মা-বাবা নয়, পরিবারের সবার জন্য খরচ করাই ইবাদত। বউ ছেলেমেয়েসহ পরিবারে সবার জন্য ব্যয় করলে হাদিসে সদকার সওয়াবের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কুরআনের ভাষ্যÑ ‘উম্মতেরা আপনার কাছে জানতে চায়! তারা কী ব্যয় করবে? বল, তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা মা-বাবা, আত্মীয়, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য ব্যয় করো।’ (সুরা বাকারা : ২১৫)
শুধু ব্যয় করবে না, ইসলাম বলছে মরে গেলেও সন্তানের সম্পত্তিতে মা-বাবার জন্য ইনসাফভিত্তিক পাওনা রেখে দিবে। কুরআনের ভাষ্যÑ ‘তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে যে, যখন তোমাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি তুমি কোনো সম্পদ রেখে যাও, তবে মা-বাবা ও নিকট আত্মীয়দের জন্য ন্যায়ভিত্তিক অসিয়ত করবে। এটি মুত্তাকিদের দায়িত্ব। (সুরা বাকারা : ১৮০)
কুরআনসহ মায়ের জন্য দুই নবীর দোয়া!
মায়ের জন্য কুরআন শিখিয়েছে- রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা!- হে আমার রব, তাদের দুজনের ওপর এমন দয়ার আচরণ করো। যেমন তারা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে। (সুরা বনি ইসরাইল: ২৪)।
মায়ের জন্য প্রার্থনা করেছেন হজরত নূহ (আ.)। বলেছেন, হে আমার রব! ক্ষমা করো আমাকে, আমার মা-বাবাকে এবং যারা আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করেছে। মুমিন নারী পুরুষকেও ক্ষমা করো। তুমি অত্যাচারীদের শুধুই যন্ত্রণা বাড়িয়ে দাও। (সুরা নূহ: ২৮)।
মায়ের জন্য প্রার্থনা করেছেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। তিনি দোয়ায় বলেছেন, হে আমাদের রব! যেদিন কেয়ামত কায়েম হবে, সেদিন আপনি আমাকে, আমার মা-বাবাকে ও মুমিনদের ক্ষমা করে দিবেন। (সুরা ইবরাহিম : ৪১)। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম