রাজনৈতিক প্রচারণায় সমন্বিত বাজারজাতকরণ যোগাযোগ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক যোগাযোগকারীকে বার্তার কাঠামোসংক্রান্ত তিনটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রথমটি হচ্ছে উপসংহার টানা প্রসঙ্গে। করণীয় প্রসঙ্গে অডিয়্যান্সকে কিছু বলা হবে কিনা, নাকি তা অডিয়্যান্সের উপর ছেড়ে দেওয়া হবে। (যেমন : ‘কে জবাব দিবে?’ ‘এর জবাব চাই’ ‘আপনার বিবেকের কাছে প্রশ্ন’, ‘জবাব দিবে বাংলাদেশ’, ‘সিদ্ধান্ত আপনার’) গবেষণায় দেখা গেছে, উপসংহার টানাই অপেক্ষাকৃত বেশি ফলপ্রসূ।
তবে সাম্প্রতিক গবেষণার সুপারিশ হচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন রেখে উপসংহারের ভার অডিয়্যান্সকে দেওয়াই ভালো। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, এক-পার্শ্বিক যুক্তি বা দ্বি-পার্শ্বিক যুক্তি কোনটা ব্যবহার করা হবে।
কেবল সফলতার দিকগুলো তুলে ধরা হবে না ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরা হবে। আমজনতার কাছে কেবল ভালো দিক তুলে ধরাই বেশি ফলপ্রসূ। তবে অডিয়্যান্স উচ্চশিক্ষিত বা বদ্ধমূল ঋণাত্মক ধারণার অধিকারী হলে ভালো-মন্দ উভয় দিক তুলে ধরাই অধিক কার্যকর। এখানে আরেকটি বিষয় বলা প্রাসঙ্গিক, কোনো সভায় বেশি বক্তার সংখ্যা যেমন অডিয়্যান্সের বিরক্তির কারণ হয়, তেমনি একটি যোগাযোগ মাধ্যমে (যেমনÑ পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, চিঠি) বহু বিষয়ের সমাবেশ ঘটানোও বিরক্তিকর। সম্ভব হলে প্রত্যেক ক্ষেত্রে একটি (বিশেষ প্রয়োজন দুই/তিনটি) বিষয়কে তুলে ধরাই শ্রেয়। মনোযোগ আকর্ষণের জন্য জোরালো যুক্তিগুলো আগে বলা ভালো। তবে শেষটাও যেন মন্দা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। বক্তব্য রাখার সময় দীর্ঘ সম্ভাষণ (…আরো উপস্থিত আছেন…) ত্যাগ করে দ্রুত মূল বক্তব্যে আসা শ্রেয়। মনে রাখতে হবে, যা একটু আগেই বলা হয় গেছে তার চেয়ে নতুন কিছু শুনতেই অডিয়্যান্স বেশি পছন্দ করে। তাৎপর্যহীন বিরক্তিকর বক্তৃতা দিয়ে পত্রিকার পাতায় ‘আরো বক্তব্য রাখেন’-এর তালিকায় ওঠার চেয়ে ‘সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন’ এর তালিকায় থাকলে কারো বিরক্তি উৎপাদনের ঝুঁকি নেই।
বার্তার ফরম্যাট: রাজনৈতিক যোগাযোগকারীকে তার বার্তার জন্য জোরাল ফরম্যাট ব্যবহার করতে হবে। যা কিছু ছাপানো হবে সেটা পোস্টার, কার্ড, ব্যানার, লিফলেটÑ যাই হোক তার শিরোনাম, কপি, ছবি এবং রঙের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এক্ষেত্রে অভিনবত্ব, বৈসাদৃশ্য, আকর্ষণীয় ছবি ও শিরোনাম, ভিন্ন ধরনের ফরম্যাট, রং, আকৃতি ও গতিকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কে বলবে?: আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর রেওয়াজ হচ্ছে সবাই বলবে। ওয়ার্ডের উপ-দপ্তর সম্পাদক থেকে শুরু করে মহানগর কমিটির মঞ্চে উপবিষ্ট সব নেতাদের বক্তব্যের পর কেন্দ্রীয় সব নেতা হয়ে বিশেষ অতিথিবৃন্দ তারপর প্রধান অতিথি, সবশেষে সভাপতি ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন। অনেকটা যেন ভিটামিন অ ঃড় ত। যোগাযোগকারীকে অডিয়্যান্স কীভাবে দেখে তার দ্বারা বার্তার প্রভাব প্রভাবিত হয়। উচ্চমাত্রায় বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে বার্তা প্রদান করা হলে তা অধিকতর প্ররোচণামূলক হয়। সবাই সব কথা বলতে চায় এটা যেমন সত্য, কিছু কিছু কথা অবশ্যই বলা উচিত সেটা কেউ বলে না। তখন দেখা যায়, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সেটা বলতে হয়। অনেক কথাই আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, যা ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদেরই মানায়।
কী কী বিষয় বা উপাদান রাজনৈতিক বক্তব্যের সূত্রকে বিশ্বাসযোগ্য হতে সাহায্য করে?
তিনটি বিষয় এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। এগুলো হলোÑ বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, বিশ্বস্ততা, পছন্দনীয়তা। বিশেষজ্ঞ জ্ঞান হচ্ছে, যোগাযোগকারী যে দাবিটি করছে তা যাচাই করার মতো তার যোগ্যতার মাত্রা। দলের শিক্ষা বা স্বাস্থ্যনীতিবিষয়ক বক্তব্য কোনো শিক্ষাবিদ বা চিকিৎসক দিয়ে বলানো গেলেই সেটা বেশি যৌক্তিক হবে। বিশ্বস্ততা নির্ভর করে সূত্রটি কতটুকু সৎ ও নিরপেক্ষ তার উপর। সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীরা যা বলে তার চেয়ে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী বা পেশাজীবীদের মধ্য থেকে কেউ বললে মানুষ সেটা বেশি বিশ্বাস করে।
দলের কোনো সাফল্যের খবর জাতীয় নিরপেক্ষ দৈনিক পত্রিকায় ছাপালে তা দলীয় বুলেটিন বা স্মরণিকায় ছাপার চেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে। অডিয়্যান্স সাধারণত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব যেমনÑ আদর্শ শিক্ষক, ক্রীড়া বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, খোলামেলা ও বোধসম্পন্ন স্বাভাবিক সূত্রকেই বেশি পছন্দ করে। বক্তব্য যদি এমন লোক দিয়ে বলানো যায় যার মধ্যে উপরোক্ত তিনটি গুণেরই সর্বোচ্চ সমন¦য় ঘটেছে তাহলেই কাক্সিক্ষত ফল লাভ সহজ হবে।
যোগাযোগের পন্থা নির্ধারণ: যোগাযোগের উদ্দেশ্য, সময় ও আর্থিক বাজেটের উপর নির্ভর করে যোগাযোগ পন্থা বা মাধ্যম কী হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন অধিকতর কার্যকর হলেও সমর্থন আদায়, কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বা ভোট প্রাপ্তির জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগ অধিকতর ফলপ্রসূ। তবে রাজনৈতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে জনসংযোগ থেকেই সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায়। গণসংযোগের জন্য যেসব সাধনী বা টুল্স ব্যবহার করা যায় এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্থানীয় কমিউনিটি কর্মকা-ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলের ইমেজ বৃদ্ধি করা। বিভিন্ন দাতব্য ও সামাজিক দায়িত্বপালনের মাধ্যমে কমিউনিটি কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করা যায়। স্থানীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করে দলের ভাবমূর্তি উন্নতি করা যায়। স্থানীয়ভাবে বিশেষ উপলক্ষে স্মরণিকা প্রকাশ, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন, প্রদর্শনী, বিশেষ ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা করে জনসংযোগ বাড়ানো যায়।
পাবলিসিটি বা প্রচার হচ্ছে, রাজনৈতিক যোগাযোগের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত জনসংযোগ সাধনী। বিনা অর্থ ব্যয়ে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা তথ্যকে পাবলিসিটি বলে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পাবলিসিটির বিশেষত্ব হচ্ছে প্রায় সব কটি মাধ্যম যেমনÑ পত্রিকা, ম্যাগাজিন, রেডিও এবং টেলিভিশন ব্যবহার করে দলের বার্তা টার্গেট অডিয়্যান্সের কাছে পৌঁছানো যায়। প্রচারের সুবিধা হচ্ছে এটা অত্যন্ত কম ব্যয়বহুল। মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কষ্টটুকুই এক্ষেত্রে প্রধান ব্যয়। যেহেতু মাধ্যমের স্থান ও সময়ের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয় না বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে (কখনো কখনো নিজেদের সহযোগী সংগঠনের মধ্যেও) মিডিয়ার স্থান বা সময় লাভের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। স্থানীয় পত্রিকায় কোনো কর্মকা-ের খবর যত সহজে একটি পূর্ণ প্রতিবেদন ছাপাবে জাতীয় পত্রিকায় হয়তো ওই প্রতিবেদন গ্রহণই করবে না। সম্প্রচার মাধ্যমে বিশেষ করে টিভিতে এ ধরনের সংবাদ প্রতিবেদন প্রচারের সময় খুব কমই থাকে। সম্পাদকীয় কর্মীরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এ সময় ব্যবহার করে। তারপর দলের ব্যাপারেও একটি অনুকূল সংবাদ সহজেই লাখ লাখ দর্শকের কাছে পৌঁছে যায় এবং ধনাত্মক ও কিছুটা স্থায়ী ইম্প্রেশন সৃষ্টি হয়।
সম্পাদনা: আশিক রহমান