চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করবে না বাংলাদেশ স্বাক্ষর হবে ২৫টি চুক্তি আর এমওইউ
হাসান আরিফ: চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করবে না বাংলাদেশ। যদিও চীন এ বিষয়ে একটি চুক্তি করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনুন্নয়নশীল দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ ডাব্লিউটিওর আওতায় বর্তমানে এ সুবিধা পাচ্ছে। চীনের বাজারে প্রায় সব পণ্যেই কোটা ও শুল্ক মুক্ত সুবিধা রয়েছে। তবে যৌথ সমীক্ষার জন্য একটি এমওইউ স্বাক্ষর করা হবে। যাতে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করা যায়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে গবেষণার জন্য জয়েন্ট স্ট্যাডি ফর এফটিএ বিটুইন বাংলাদেশ টু চায়নাবিষয়ক একটি এমওইউ স্বাক্ষর করা হবে। এ এমওইউ স্বাক্ষর হলে দুই দেশের মাধ্যমে বিনিয়োগ ফোরাম করে গবেষণা করা হবে। এ গবেষণায় দেখা হবে এফটিএ হলে কোন দেশ কতটা লাভবান হবে। যদি বাংলাদেশ মনে করে এ চুক্তি করলে লাভবান হওয়া যাবে তবেই এফটিএ হবে নয়তো বা হবে না।
সূত্রটি আরও জানায়, বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে দেশের হালকা প্রকৌশল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ চীন এখন এ খাতে ব্যাপক উন্নতি করেছে। রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা। তাছাড়া তারা সস্তায় যেকোনো পণ্য সহজেই তৈরি করতে পারে। ফলে দেশের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো চুক্তি চীনের সঙ্গে করা হবে না।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) মনোজ কুমার রায় এ প্রতিবেদককে বলেন, এলডিসি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ চীনের বাজারে শুল্ক ও কোটা মুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। তাই এ মূহুর্তে চীনের সঙ্গে নতুন চুক্তির প্রয়োজন নেই। তবে এলডিসি থেকে গ্রাজুয়েশন করলে এফটিএ বা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।
এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরেই ২৫টি প্রকল্পে চুক্তি ও এমওইউ স্বাক্ষর হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে ২ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। তাই চীনা প্রেসিডেন্টের আজকের ঢাকা সফরকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ।
অর্থমন্ত্রণালয় ও ইআরডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোটামুটি সব বৃহত্তম প্রকল্পগুলোতেই চীন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। তবে এসব বিষয় রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আরইডির কাজ শুধু তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা। এর ভাল-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরা।
ইআরডি সূত্র জানায়, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেতে পারে বাংলাদেশ। ৫ বছরে ২৫টি উন্নয়ন প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় হবে। এছাড়া দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের প্রস্তাব রয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংকের ঋণে।
সূত্র জানায়, চীন সরকার চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে কর্ডলাইন নির্মাণ, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগসহ যশোর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ডিজিটাল কানেকটিভিটি, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) শক্তিশালীকরণ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি অ্যান্ড সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্পে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রেসিডেন্টের সফরে চার প্রকল্পের ঋণচুক্তি হতে পারে। এ প্রকল্প চারটি হলোÑ ডেভেলপমেন্ট অব ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা-নেটওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট ফেজ-৩, এতে চীনের বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ডলার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প, এর বিনিয়োগের পরিমাণ ৭০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার, ২৮ কোটি ডলারে চট্টগ্রামে চীনের অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ অঞ্চল স্থাপন এবং চীনের ১৮ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ঋণে ছয়টি জাহাজ ক্রয়।
এছাড়া বাণিজ্য চুক্তি হতে পারে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে, এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬০ কোটি ৩২ লাখ ডলার। পায়রা কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আসতে পারে ৩ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি। সীতাকু-ু-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলীয় সড়ক নির্মাণে রয়েছে ২৮৫ কোটি ৬৫ লাখ ডলার ঋণ প্রস্তাব। আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত রেললাইন ব্রডগেজে উন্নীতকরণ প্রকল্পে রয়েছে ১৭৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার ঋণ প্রস্তাব।
বাণিজ্য চুক্তির জন্য তালিকায় রয়েছে ৫০ কোটি ডলারের ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রজেক্ট, ৫০ কোটি ডলারের রাজশাহী ওয়াসার সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রজেক্ট, ১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের সিস্টেম লস রিডাকশন বাই রিপ্লেসিং ফাইভ মিলিয়ন ইলেকট্রো মেকানিক্যাল এনার্জি মিটার উইথ ইলেকট্রনিক এনার্জি মিটার প্রজেক্ট ও ২০ কোটি ডলারের মর্ডানাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কানেকটিভিটি প্রকল্প।
এছাড়া ২০৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে এক্সপানশন অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক আন্ডার ডিপিডিসি এরিয়া প্রজেক্ট, ৯১ কোটি ৭১ লাখ ডলার ব্যায়ে পদ্মা ব্রিজ রেল লিঙ্ক ফেজ-২, ১৩২ কোটি ১৮ লাখ ডলার ব্যয়ে পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক স্ট্রেনদেনিং প্রজেক্ট আন্ডার পিজিসিবি, ১৬৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার ব্যয়ে পদ্মা ব্রিজ রেল লিঙ্ক ফেজ-১ কনস্ট্রাকশন ও ১৩৯ কোটি ডলার ব্যয়ে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পসহ বেশকিছু প্রকল্পে চীনের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যেতে পারে বলে জানা গেছে ইআরডির সূত্রে।
একই সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে ঋণের প্রতিশ্রুতি ছাড়াও চীনের উদ্যোক্তাদের জন্য চট্টগ্রামে একটি অর্থনৈতিক ও শিল্প জোন এবং মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় তৈরি পোশাক খাতে বড় অঙ্কের চায়না বিনিয়োগ দেশটির প্রেসিডেন্টের সফরে নিশ্চিত হতে পারে। এরই মধ্যে চায়না অর্থনৈতিক ও শিল্প জোন স্থাপনে সহজ শর্তে ২৮ কোটি ডলার ঋণ দিবে।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ১৪তম যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) সভায়ও বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা গুরুত্ব পায়। ওই সভায় চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার গাও ইয়ান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জোনে বিনিয়োগ এবং তৈরি পোশাক খাতে চীন তাদের দেশের বেশকিছু বিনিয়োগ বাংলাদেশে স্থানান্তর করবে বলে জানান। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরে এ বিষয়ে একটি ঘোষণা আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অবকাঠামো খাতে প্রতিবছর ৭ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। যা শুধু বিশ্বব্যাংক, জাইকা বা এডিবি দিয়ে হবে না। তাই বিকল্প বিনিয়োগের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। সে ক্ষেত্রে চীনের কাছ থেকেও অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্পের জন্য ঋণ নেওয়া যেতে পারে।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, অনেক সময় চীন থেকেই প্রকল্পের পণ্য কেনা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। অনেক সময় উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পণ্য কিনতে বাধ্য করে থাকে চীন সরকার। ঠিকাদার নিয়োগেও একই প্রবণতা দেখা যায়। ঠিকাদার নিয়োগ ও উপকরণ কেনায় উন্মুক্ত দরপত্র ডাকা না হলে পণ্য ও কাজের গুণগত মান নিশ্চিত হয় না বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। এসব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তবে সব কিছুর আগে অর্থায়নের শর্ত মূল্যায়ন করতে হবে। গ্রেস প্রিয়ডও দেখতে হবে। আর ভালো প্রকল্প মূল্যায়ন করতে পারলে লাভবান হওয়া যাবে। সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ দত্ত