বেদে সম্প্রদায় কি হারিয়ে যাবে?
সৈয়দ রশিদ আলম
সত্তর দশক পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে, উপন্যাসে, গল্পে ও কবিতায়, পরবর্তীতে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে বেদে সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। তারপর থেকে সাহিত্যের পাতা থেকে ও চলচ্চিত্রের পর্দা থেকে বেদে সম্প্রদায় অঘোষিতভাবে হারিয়ে গেছে। কিন্তু কেন? এমন একটি সময় ছিল বাংলাদেশের গ্রামের প্রতিটি প্রান্তে বেদে সম্প্রদায়কে দেখা যেত। গায়ের বধূরা বেদে রমণীদের দ্বারা নানাধরনের সৌখিন জিনিস ক্রয় করতেন।
কেউবা দাঁতের পোকা দূর করতেন, কেউবা সাপের বিষ তুলতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বেদে সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। তাদের কেউ এখন খুব একটা বিশ্বাস করে না। একটি সময় বেদে সম্প্রদায় জলের উপর নির্ভরশীল ছিল। জলকেন্দ্রিক বেদে সমাজের সবকিছু নৌকাতেই হতো। আস্তে আস্তে বেদে সম্প্রদায় জলকে পরিত্যাগ করে ডাঙাতে ঘরবাড়ি নির্মাণ শুরু করে। অনুমান করা হয়, আরব অঞ্চল থেকে আগত প্রায় সাত থেকে আটশ বছর পূর্বে যাযাবর বেদুইন সম্প্রদায় থেকে বেদে সম্প্রদায়ের আবির্ভাব। বেদে সমাজকে নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে একাধিক গবেষক গবেষণা করেছেন। বেদে সম্প্রদায় মূলত চারটি দলে বিভক্ত, যেমনÑ বেদে, সান্দার, মান্তা ও ফিরিঙ্গি। বেদেদের সারা বাংলাদেশে দেখা গেলেও সান্দার সম্পদ্রায়কে ঢাকার সাভার, বক্তারপুর, পুবাইল, খুলনার কিছু অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। মান্তাদের শুধুমাত্র পটুয়াখালীর দশমিনা ও গলাচিপা উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে নৌকায় দেখতে পাওয়া যায়।
আর ফিরিঙ্গি সম্প্রদায়কে শুধুমাত্র ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জের কিছু অঞ্চলে দেখা যায়। প্রযুক্তি নির্ভর মানুষ বেদে সম্প্রদায়ের উপর আস্থা হারানোর পর থেকে বেদে সম্প্রদায় বিভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে, মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান। কিন্তু ধর্ম পালন করার ক্ষেত্রে কারোরই তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কেউবা পীরের অনুসারী, কেউবা কোনো দেব-দেবীর অনুসারী। স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বাধিক ব্যবসাবহুল চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটি তৈরি হবার পর বেদেদেরকে নিয়ে আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ দেখাননি। সাহিত্যিকেরা বেদে সম্প্রদায়কে তাদের সাহিত্যে আর আনতে চান না, ব্যতিক্রম শুধু স্বকৃত নোমান। তার রচিত জলেশ্বর উপন্যাসটি পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
এই উপন্যাসে সান্দার সম্প্রদায়কে তুলে ধরা হয়েছে, বড় মমতার সঙ্গে সান্দার সম্প্রদায়ের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, ভালোলাগা- ভালোবাসা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে আমরা আর কোথাও বেদে সম্প্রদায়কে দেখতে পাই না। মাঝে মাঝে পথে-ঘাটে বেদে রমণীদের কৌটার মধ্যে সাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তারপরও সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ এই বেদে সম্প্রদায়। কালের গর্ভে এই বেদে সম্প্রদায় কি হারিয়ে যাবে?
লেখক: কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান