রাজনৈতিক প্রচারণায় সমন্বিত বাজারজাতকরণ যোগাযোগ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রচারের মাধ্যমে উদ্দিষ্ট অডিয়্যান্সকে প্রভাবিত করার মতো বিশ্বাসযোগ্য বার্তা উপস্থাপন করা হয়। প্রচারকারীকে মনে রাখতে হবে, প্রচার হচ্ছে নিশ্চিতভাবে সংবাদেরই একটা ধরন। ভালো সংবাদ, গল্প তৈরির মতো গুণাগুণ ও মাল-মসলা থাকলেই কেবল এটা সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। প্রচারণা সময়মতো এবং টাটকা হতে হবে। বিষয়টির ব্যাপারে মাধ্যমের অডিয়্যান্সের বড় একটি অংশের আগ্রহ থাকতে হবে এবং সেটা অবশ্যই সঠিক হতে হবে। গল্পটির মধ্যে নাটকীয়তা থাকলে অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে গণ্য হবে। সবার জন্য প্রচারণার অন্যতম ধরন হচ্ছেÑ প্রেস রিলিজ। সংবাদ গুণসম্পন্ন কোনো ঘটনার বিবরণ সম্ভব হলে ছবিসহ এক বা দুই পৃষ্ঠার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে কম্পোজ করে সম্ভাব্য সব মাধ্যমের কাছে তা পৌঁছে দিতে হবে। এ ধরনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রচারের বিষয়টি নির্ভর করে সংবাদমূল্য বা বিষয়বস্তু, স্থান ও সময় পর্যাপ্ততা এবং মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগকারীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিস্তারিত প্রেস রিলিজ অপেক্ষা শিরোনামযুক্ত ৮ ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি সাইজের ফটোই সম্পাদকের কাছে বেশি আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য হয়।
প্রচারণার আরেকটি ধরন হচ্ছেÑ প্রেস কনফারেন্স। বিশেষ করে বড় ধরনের ঘোষণা বা ঘটনার ক্ষেত্রে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। কেন্দ্রীয় বা সুবিধাজনক কোনো স্থানে সাংবাদিকদের আহ্বান করে তাদের সামনে ঘোষণাটি পড়ে শোনানো হয়। সাংবাদিকরা ঘটনার বা ঘোষণার বিভিন্ন দিক বিস্তারিত জানার জন্য প্রশ্ন করে থাকেন। এ ধরনের অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের উপস্থিত থাকা বা সভাপতিত্ব করা উচিত। সুপরিকল্পিত সংবাদ সম্মেলনের ক্ষেত্রে উপস্থিত সাংবাদিকদের জন্য মুদ্রিত বক্তব্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমনÑ নমুনা, ফটো আলামত তৈরি রাখা হয়। এ ধরনের সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিক ও উপস্থিত অন্যান্যদের জন্য পৃথক অথবা যৌথভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রচার কার্যক্রমের সফলতার অন্যতম নির্ধারক হচ্ছে মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং তা বজায় রাখা। পুরো মিডিয়ার সম্পাদক বা কোনো বিশেষ অংশ বা সংস্করণের সম্পাদক মিডিয়ার গেট রক্ষকের ভূমিকা পালন করে। তারাই সিদ্ধান্ত নেয় তাদের নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমের স্থান বা সময়ে কার কী তথ্য প্রচার করবে। তাদেরকে বরাদ্দকৃত পৃষ্ঠা বা মিনিটের দায়িত্ব নিতে হয়। প্রায় সময়ই এ কাজের জন্য নিজস্ব রিপোর্টিং স্টাফ থাকে না, যাদের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত পৃষ্ঠা ও সময় ভরাট করা যায়, যার কারণে তাদেরকে বিভিন্ন সংগঠনের পাবলিসিটি উপকরণের উপর নির্ভর করতে হয়। তাদের পক্ষে জমাকৃত (বিশেষ করে ঋধী বা ইন্টারনেট-এ আসা) সব পাবলিসিটি উপকরণ ব্যবহার সম্ভব হয় না। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে প্রতিযোগী উপকরণগুলো থেকে প্রচারযোগ্য উপকরণ নির্বাচন করতে হয়।
প্রতিকূল প্রচারণা বা গুজব মোকাবিলা: এ পর্যন্ত আমরা প্রচারের ভালো দিক সম্পর্কে আলোচনা করেছি, যার দ্বারা দলের ইমেজ বৃদ্ধি সম্ভব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও রাজনৈতিক দলকে ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোকে প্রায়ই প্রতিকূল প্রচারণার বা গুজবের মোকাবিলা করতে হয়। এসব ঘটনার নিয়ন্ত্রণ প্রায়ই দলের হাতে থাকে না। যেমনÑ গুজব, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত, নেতাকর্মীর কোনো কেলেঙ্কারি, মিথ্যা মামলা ইত্যাদি। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় দলকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধান দুটি কাজ হচ্ছে প্রথমত, এ ধরনের প্রতিকূল অভিজ্ঞতা প্রতিরোধের জন্য পূর্ব থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে দল কী প্রতিক্রিয়া করবে তার একটি কন্টিনজেন্সি পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই তৈরি রাখা। এ ধরনের পরিকল্পনা বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘটনার আকস্মিকতা ও ঘোলাটে অবস্থা ন্যূনতম রাখতে সাহায্য করে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক হয়। দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তা মোকাবিলায় প্রচার পরিকল্পনা তৈরির সময় পাওয়া যাবে না, তখন মিডিয়ার সঙ্গেও সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক যোগাযোগের অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছেÑ গুজব। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গুজব রটনা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি দেখা যায়। গুজব রটনাকারী তাদের স্বার্থে তথ্যের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে কোনো প্রমাণ ছাড়াই মিথ্যা কথা ছড়াতে থাকে। গুজব রটনার জন্য বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় না। এর কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও নেই। গুজব বাতাসের চেয়ে আগে ছড়িয়ে পড়ে। গুজব রটনাকারী বিষয় ও সময়ের সমন¦য় ঘটায়। গুজব রটনা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। গুজব নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করতে হবে সেটাই এখানে আলোচনা করছি।
গুজব হচ্ছে খোশগল্পের অযাচাইকৃত ও অসত্য অংশ, যা কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ে। কখনো কখনো যা রটে তার কিছুটা ঘটে হলেও, গুজব কখনো প্রত্যাশিত হতে পারে না। গুজব প্রথমত পরিস্থিতির অস্পষ্টতা ও রটনাকারীর স্বার্থ হাসিলের চেষ্টার ফল। গুরুত্বহীন হলে এবং ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট না হলে গুজব এমনিতে থেমে যায়। যেমন লক্ষ্মীপুরের চরাঞ্চলের মহিষের সংখ্যা নিয়ে কোনো গুজব আমরা শুনেছি বলে মনে হয় না। গুজব অনেক ধরনের হতে পারে। কিন্তু আছে ঐতিহাসিক ও ব্যাখ্যামূলক। এক্ষেত্রে রটনাকারী অতীতের কোনো অস্পষ্ট ঘটনার নিজস্ব অর্থ দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। কতগুলো গুজব আছে আরো অ্যাকশনধর্মী; পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার জন্য এগুলো রটানো হয়। প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, দ্বন্দ্ব সৃষ্টি ইত্যাদি নানা কারণে অর্থ-ধর্ম-নারী ইত্যাদি বিষয়ে গুজব রটানো হয়। গুজব ব্যবস্থাপনার প্রধান করণীয় হচ্ছেÑ তাৎপর্য, স্বার্থ ও গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করা। সব গুজবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নাও হতে পারে। অসত্য গুজব মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে টর্নেডোর মতো বিপর্যয় ছড়াতে পারে।
গুজব মোকাবিলার জন্য যা করণীয় তা হলো: গুজব ঠেকানোর জন্য এর কারণ নির্ণয় করতে হবে। কেবল মারাত্মক গুজব দমনের চেষ্টা করতে হবে, সব গুজব নয়। তথ্য দিয়ে গুজবের জায়গা ভরাট করতে হবে। গুজব খুব দ্রুত মোকাবিলা করতে হবে। মুখোমুখি তথ্য প্রদান এবং প্রয়োজনে লিখিত তথ্য দিয়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সত্য জানাতে হবে। গুজব রটনা বন্ধের প্রচেষ্টাকালে গুজবটি উচ্চারণ করা যাবে না। সমাজের নেতাদের সহযোগিতা নিতে হবে, যদি তারা সহযোগিতা করতে চায়। সব গুজব মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে।
দলের যাবতীয় বক্তব্য ও বার্তাকে এক সূত্রে গেঁথে জনগণের মনে দলের একটি জোরালো ভাবমূর্তি সৃষ্টির উদ্দেশে সব প্রচার ও যোগাযোগকে সমনি¦ত করাই সমনি¦ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। সমনি¦ত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যোগাযোগের সব মাধ্যমে দলের কর্পোরেট কালচার সমৃদ্ধ হয়, কারণ এর মাধ্যমে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একইভাবে দলের বক্তব্য, কর্মসূচি ও ব্যক্তিকে তুলে ধরা হয়। এর অর্থ হচ্ছেÑ যোগাযোগের বা গণসংযোগের উপকরণাদির ভাষা এমনভাবে সুবিন্যস্ত হবে, যাতে সবগুলোতে অনুভূতির মিল থাকে। এ ব্যাপারে সংগঠনের সবাই কমবেশি দায়িত্বপালন করলেও প্রচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাদেরকেই মূল দায়িত্বপালন করতে হবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান