১০ টাকা কেজি চাল, তুমি কার!
ওয়াসিম ফারুক
‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার এই অংশটি হয়তো অজানা তেমন কেউ নেই। সেই অনেক পুরনো যুগ থেকেই সমাজের বিত্তশালী ধনাঢ্যরা গরিবের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলে আসছে। ধনাঢ্যদের অঢেল সম্পত্তির মাঝেও গরিবের ওই সামান্যটুকুর লোভী দৃষ্টি থেকেই যায়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট ক্ষমতাসীন হওয়ায় রাজনীতির ময়দানসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন সরকারের একটি বিষয় নিয়ে বিশেষ রাজনীতি শুরু হয়েছিল, তা হলো ১০ টাকা কেজি দরে চাল। তৎকালীন সময় টাঙ্গাইলসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় নির্বাচনি জনসভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি তথা তার জোট ক্ষমতায় গেলে দেশের মানুষকে দশ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াবেন। এটা যদিও তৎকালীন আওয়ামী জোটের নির্বাচনি ইশতেহারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না, তারপরও এ নিয়ে সরকার বিরোধিদের সমালোচনার কমতি ছিল না। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখের সেই কথাই বাস্তবায়ন হয়েছে।
বর্তমান সরকারের ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’ এর আওতায় ৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ১০ টাকা কেজি দরে হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চাল বিতরণ। সারাদেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র মানুষের মাঝে ১০ টাকা কেজি দরে চাল পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের চিলমারিতে গিয়ে এই কর্মসূচির শুভ উদ্বোধন করেন। অথচ এই কর্মসূচি নিয়ে অভিযোগ, অনুযোগ আর দুর্নীতির যে কোনো কমতি নেয়। কলেজ শিক্ষক থেকে শুরু করে জামায়াত নেতা কে পায়নি হতদরিদ্রদের ১০ টাকা কেজি দরে চাল ক্রয়ের কার্ড? স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা বাদই দিলাম। তবে আমি চাইলেই কি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম বাদ যাবে? না কখনোই না। পত্রিকার খবরে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে হতদরিদ্রের তালিকায় আওয়ামী লীগ নেতারও নাম আছে। শুধু ওই নেতাই নন, তার পরিবারের সবার নামেই হতদরিদ্রের কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। হতদরিদ্রের কার্ড আছে রানীশংকৈল উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতা প্রভাষক সফিকুল আলমের নামও যার কার্ড নং-১০০৮। এ নিয়ে এলাকায় আলোচনার ঝড় উঠেছে। মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের, তার স্ত্রী দিলু আরা (কার্ড নং-১৬২), তার ৪ ভাইÑ রবিউল ইসলাম (কার্ড নং-১৪১), রেজাউল করিম (কার্ড নং-১৫৩), আখতার আলম (কার্ড নং-১৫৬), হোসেন আলী (কার্ড নং-১৬৩)।
যশোরের কেশবপুরে তো অনিয়মের অভিযোগে হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকৃত হতদরিদ্রদের তালিকা প্রণয়ন করে পুনরায় চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শরীফ রায়হান কবিরের ভাষ্য মতে, উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির তালিকায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকৃত হতদরিদ্রদের বাদ দিয়ে সমাজের অনেক বিত্তবানের নামে কার্ড দেওয়া হয়েছে। জয়পুরহাট সদরের ভাদসা ও পাঁচবিবি উপজেলায় বঞ্চিতরা অনিয়মের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়েছেন। অল্প মূল্যের সরকারি চালের কার্ড পাইয়ে দেবার কথা বলে কোথাও কোথাও স্থানীয় কিছু মেম্বার-চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে উঠেছে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগও। আর হর-হামেশাই সংবাদ মাধ্যমের সংবাদ হচ্ছে হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রি হচ্ছে খোলা বাজারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ দেশের মানুষের সঙ্গে যে ওয়াদা করেছিলেন তা কিছুটা হলেও পূরণে স্বার্থক হয়েছেন। তাই তার ওয়াদার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই জন্য তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াদাকে বরখেলাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তার দলসহ তাদের জোটেরই কিছু নেতাকর্মী ও তাদের আশ্রয়ে থাকা এক শ্রেণির অসাধু সিন্ডিকেট। যারা নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই মহৎ উদ্যোগকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে পুরো কর্মসূচিকেই কলঙ্কিত করার পায়তারায় লিপ্ত। বর্তমান সরকার প্রদত্ত ১০ টাকা কেজি দরের চাল অবশ্যই দরিদ্র মানুষের জীবনে এক নতুন স্বস্তির জন্ম দিয়েছে। এতে অবশ্যই দেশের হতদরিদ্র মানুষেরা পেটভরে ভাত খাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু সমাজের কিছু বিবেকবর্জিত মানুষ যখন তাদের স্বপ্নকে শুধু স্বপ্নেই রাখার যে পায়তারা করছেন তাদের ধিক্কার জানানোর ভাষাও আমাদের জানা নেই। প্রশাসনসহ জনপ্রতিনিধিদের কাছে একটাই আবেদন থাকবেÑ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এ দেশের হতদরিদ্র মানুষদের পেট ভরে ভাত খাওয়ার যে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চলছে তা আপনাদের সহযোগিতায়ই সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাবে।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান