বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ হবে ৩৮.৬১ বিলিয়ন বর্তমানে আছে ৫৬.৭৯ মিলিয়ন ডলার
হাসান আরিফ: চীনের রাষ্ট্রপতি গত দুইদিনে বাংলাদেশ সফরে যেসব চুক্তি আর সমঝোতা করেছেন তার আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আর সব মিলিয়ে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৩৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ বিনিয়োগ হলে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের ‘নতুন দিগন্ত’ উন্মোচিত হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে চীনের প্রধান বিনিয়োগ টেক্সটাইল খাতে। এর বাইরে রয়েছে রাসায়নিক সার, বিদ্যুৎ, ওষুধশিল্প। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ৫৬ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যার ৬৫ শতাংশই রয়েছে টেক্সটাইল খাতে।
ভারতের এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নে সহজ শর্তে প্রতিবেশী দেশ ভারত ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি করেছিল গত বছর। আর এর জবাবে চীন বাংলাদশের সঙ্গে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করলো।
চীনের বেসরকারি কোম্পানির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ রয়েছে। বিদ্যুৎ ও ম্যানুফ্যাকচারিংসহ বিভিন্ন খাতে চীনা বিনিয়োগকারীরা প্রবেশ করছেন। কারণ এসব খাতের রয়েছে সম্ভাবনা। বাংলাদেশে আরও শিল্প পার্ক স্থাপিত হলে সে দেশে বিনিয়োগের পথ চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য আরও প্রশস্ত হয়ে যাবে।
চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আগ্রহের মূল কারণ কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। ৬ থেকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনও করছে এই দেশ। তাছাড়া বাংলাদেশে শ্রম ব্যয় অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম। পারিশ্রমিক তুলনামূলক কম এমন খাতে বিনিয়োগ করতে পারা চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য হবে বড় সুযোগ। এদিকে বাংলাদেশ সরকার দেশে ব্যবসায়ের পরিবেশ উন্নয়নে বেশকিছু নীতি গ্রহণ করেছে। তাই দুই দেশের সরকারই বাণিজ্য সফরে ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলকে সহযোগিতা ও উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। এতে চীনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের ব্যাপারে জানার সুযোগ পাচ্ছেন। তারা সুযোগটি কাজেও লাগাচ্ছেন।
চীন সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট এবং টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ম্যারিটাইম সিল্ক রোড নিয়ে অনেক বড় স্বপ্প দেখছে, যাকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’। চীন তাদের এই স্বপ্নের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ (বিঅ্যান্ডআর) বাস্তবায়নের জন্যও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চায়। এজন্য বাংলাদেশকে চীনের প্রয়োজন রয়েছে। আর রাজনৈতিক অবস্থান বিচারে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের দেশগুলোর মধ্যে সংযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ সফল করতে চাইলে বাংলাদেশের এই ভৌগোলিক অবস্থানকে চীনের কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ-চীন-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডর প্ল্যানও বাংলাদেশকে ছাড়া হবে না।
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ চীনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ। এর আগেই বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ইতিহাসটি আরও অনেক পুরনো। কূটনৈতিক সম্পর্কের হিসাবে এই বন্ধন ৪১ বছরের। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই করিডর তৈরির প্রস্তাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনও ছিল। বঙ্গোপসাগর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এক জলসীমা এবং বাংলাদেশ এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘হাব’। এ কারণে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় সিল্ক রোড পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
বাংলাদেশ ও চীন দুই বন্ধুপ্রতীম দেশ। এই সম্পর্ক ধরে রাখার স্বার্থেও বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন, এমনটাই মনে করে চীন। চীনের প্রত্যাশা, দুই দেশই ‘সিল্ক রোড স্পিরিট’-এ উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে যাবে।
চীন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অংশ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকা-ে অবদান রেখেছে। এর মধ্যে যোগাযোগ খাত অন্যতম। আশির দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতটি বড় সেতু চীন নির্মাণ করেছে। এ মুহূর্তে আরও আটটি সেতু নির্মাণাধীন। চীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশ আশির দশকে পেইচিং নাম্বার ওয়ান এক্সপেরিমেন্টাল এলিমেন্টারি স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেছিল। এই অনুদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্কুলটির নামকরণ হয়েছিল চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এলিমেন্টারি স্কুল। একই ভাবে দিয়েছিল চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্স হল। পরে বর্তমান সরকার এর নাম পরিবর্তন করে রেখেছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র।
বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে চীনা বিনিয়োগের ফলে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, যার আর্থিক মূল্যমান ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকনোমিস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের অধিকাংশই দরিদ্র। তারপরও বছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হচ্ছে গড়ে ৭ শতাংশ করে। কিছু সামাজিক মানদ-ে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। চীনের পর দেশটি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ। বিদেশ থেকে নিজ দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন এক কোটি প্রবাসী কর্মী। গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়লেও বিকশিত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। দ্রুত বিকশিত এই অর্থনীতির দিকে এখন অনেকেরই দৃষ্টি। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফর এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্রমশ এগিয়ে যাওয়াসহ নানা বিষয়ে মন্তব্য রয়েছে এই প্রতিবেদনে। সম্পাদনা : উম্মুল ওয়ারা সুইটি