চীনের নয়া কূটনৈতিক নীতি
মোহসীন আব্বাস: চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফর শেষ করলেন শনিবার সকালে। তারপর ভারত গেছেন ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে তিনি বিমসটেক আঞ্চলিক জোটের বৈঠকেও অতিথি হিসেবে থাকবেন। বাংলাদেশে জিনপিং উষ্ণ সংবর্ধনা পেয়েছেন। এই সফরের খোয়ারি কাটেনি এখনো। তবে জিনপিং-এর সফর শেষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিপক্কতার পরিচয় বহন করে। সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, শি জিনপিং-এর সফর কালে সই করা চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে দু’দেশই লাভবান হবে। কথাটা সত্যি এবং চীনের নয়া কূটনৈতিক নীতির সঙ্গে মিল রয়েছে।
চীনের কূটনৈতিক নীতিতে বদল এসেছে বেশ ক’বছর আগেই। অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান বিকাশ তাকে প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। চীনকে এখন প্রতিযোগিতা করতে হচ্চে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। এই প্রতিযোগিতা এখন আর কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক এবং সামরিকও। আর এই নতুন চাপ চীনকে ঠেলে দিয়েছে নতুন করে শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণে।
অর্থনীতিবিদগন এখন একটা কথা প্রায়শই বলেন, এ যুগটা হলো সম্মিলিত বিকাশের যুগ। অর্থনীতির এই প্রবণতাকে চীন গ্রহণ করেছে তার কূটনৈতিক নীতিতে। যেটা যুক্তরাষ্ট্র পারেনি। নানা করণেই পারেনি। না পারার মূলে আছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চিন্তকদের দুই গোষ্ঠি শিকাগো স্কুল এবং কেইনস স্কুলের মধ্যে দ্বন্দ্ব। কেইনস স্কুল উদার ধনবাদের সমর্থক। আর, শিকাগো স্কুল আগ্রাসী বাজার অর্থনীতির সমর্থক। এর বাইরে আছে মার্কিন রাজনৈতিক চিন্তক ও দলগুলোর মধ্যে প্রবাহিত নানা মতধারা। আছে ব্যবসায়ী-রাজনীতিক টানাপোড়েন। চীনে তা নেই। চীনা সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো একরৈখিক। তাই দেশটি থিওরি অব গ্রোয়িং টুগেদার নীতিকে দ্রুত গ্রহন করতে পেরেছে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীতার জের ধরে এশিয়া এবং চীন সাগর থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত জলপথ এখন এই প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য উত্তেজনার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। চারপাশে ব্যবসা-বাণিজ্যের আলাপ যেমন আছে, তেমনই আছে সামরিক মহড়া। বানিজ্য চুক্তির পাশাপাশি সম্পাদিত হয় সামরিক চুক্তি। যাকে কূটনীতিক ও রাজনীতিকরা আদর করে ডাকেন কৌশলগত চুক্তি। আজকের আন্তনির্ভরশীল বিশ্ব ব্যবস্থায় সরাসরি সামরিক বিষয় সংশ্লিষ্ট বিষয়-আশয়ের বাইরেও যেসব বিষয় সামরিক কৌশল নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে সেসব বিষয়ও কৌশলগত অংশিদারিত্বের বিবেচনার বিষয়। উদাহারণ হিসেবে বলা যেতে পারে পানিসম্পদ, খাদ্য ও জ্বালানী সম্পদের নাম। মাত্র দু’দিন আগেও অভিন্ন নদী আলোচিত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময়। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ অবশ্যই চীনের কৌশলগত অংশিদার। ভারত, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও একই ধারায় বিবেচিত হতে পারে।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে চীনের সামরিক এবং অর্থনৈতিক পরিধির সামনে বাংলাদেশের অবস্থান তত বড় নয়, তারপরও বাংলাদেশ কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশের এই গুরুত্বের পেছনে ক্রীয়াশীল বাংলাদেশেন সাম্প্রতিক বিকাশ, ভৌগলিক অবস্থান এবং চীনের কূটনৈতিক নীতিতে বদল।
চীন, ইন্দোচীনের দু’একটা ঘটনার বাইরে এখনো কোন দেশের অভ্যন্তরীর রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি। প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রবণতা প্রকট ও প্রবল। এমনধারার প্রতিদ্বন্দ্বিকে মোকাবেলা করতে, আপাতত পশ্চিমে মিত্রের সন্ধান করতে চাচ্ছে না চীন। পূর্বে চীনের মিত্র, শত্রু এবং শত্রুও নয় মিত্রও নয় এমন দেশের অবস্থান। আর এই পরিস্থিতিটাকেই অর্থনীতির প্রভাব দিয়ে জয় করতে চাইছে চীন। এশীয় দেশগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ন দেশ হলো জাপান, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ইরান, সৌদিআরব ও তুরস্ক। রাশিয়া ইউরোপও নয়, এশিয়াও নয়। এই বিশাল ভুখ- নিজেই এক অঞ্চল। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোও এখন কম বেশি রাশিয়া প্রভাবাধীন। এ বিবেচনায় মধ্য-এশিয়া ও রাশিয়া মিলে এই বিশাল অঞ্চল আসলে এক মহাদেশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বিবেচনা করলে অস্ট্রেলিয়াকে দূরের বিবেচনা ঠিক হবেনা। বরং ভারত মহাসাগরে দেশটির রয়েছে সরব উপস্থিতি।
এই অঞ্চলেও চীনের প্রতিযোগিতা আছে। জাপানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সত্বেও ব্যবসা-বানিজ্য থেমে নেই। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছেনা। দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সক্রীয় মিত্র। এমন পরিস্থিতিতে ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের নীতিকে চীনের প্রয়োগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বলেই মনে হয়। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয় ও অষ্ট্রেলিয়ার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ দেশ। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে রয়েছে ঠান্ডা লড়াই। চীনের সঙ্গেও সমুদ্র সীমা নিয়ে টানাপোড়ন আছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রকে বকাঝকা করলেও আখেরে মার্কিন মিত্র। তাই এ অঞ্চলে মালয়েশিয়ার সঙ্গে একত্রে বিকাশের নীতি প্রয়োগ ছাড়া আর চীনের উপায় কী? থাইল্যান্ড মার্কিন মিত্র, মিয়ানমারের বর্তমান নেতৃত্ব পশ্চিম ঘেঁষা হলেও দেশটির সঙ্গে চীনের বন্ধন ঐতিহাসিক। তাই মিয়ামারের সঙ্গে বিরাজিত সমস্যা মিটিয়ে ফেলাকেই উত্তম মনে করে চীন।
ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অম্ল-মধুর। মনে হয় সীমান্তে যুদ্ধ বেধে যাবে, কিন্তু বাধে না। সহযোগিতা বাড়ে। একদা বিছিন্ন ইরান চীন সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষন করেনা। শ্রীলংকার সঙ্গে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক সমান ভাবে উষ্ণ। সৌদি আরবের দিকে সম্পর্কের হাত বাড়িয়েছে চীন। সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। অথবা সফলতা আসতে দেরি হবে। পাকিস্তান পরীক্ষিত মিত্র তবে স্বার্থপর। আরব সাগর ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উঠান। পাকিস্তানের মিত্রতায় আজ উইঘুর অঞ্চলে জঙ্গিবাদ বিস্তারের শঙ্কা। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় চীন আর কাকে পাশে চাইতে পারে?
বাংলাদেশের সঙ্গে, বিশেষভাবে বললে বাংলার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক প্রাচীন। ভৌগলিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণসহ নানা কারণেই চীনের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক বন্ধুত্ব হয়নি ওই কালে। আধুনিক দুনিয়ায় বাংলা অখ- থাকেনি। অবশেষে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী স্বাধীণতা যুদ্ধে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের জন্মে চীনের ভুমিকা নেই, বরং বিরোধীতা আছে। তারপরও চীনের অর্থনৈতিক বিকাশ ও বানিজ্য নীতি বাংলাদেশকে আকর্ষণ করেছে শিশু কাল থেকেই।
আজ বাংলাদেশ আর সাহায্য নির্ভর কোন রাষ্ট্র নয়। বিকাশমান অর্থনীতি। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ এখন ব্রান্ডনেম। এমন একটি দেশের ভৌগলিক অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মাঝখানে বঙ্গোপসাগরের তীরে। সার্কের প্রভাবশালী সদস্য বাংলাদেশ বিমসটেকের সদস্য। এ বিবেচনায় দু’দিকেই বাংলাদেশ এ অঞ্চলে প্রভাবশালী।
শেষ কথা হলো, এখন বিশ্ব কূটনীতি পরিচালিত হয় প্রয়োজন নির্ভর নীতি দিয়ে। একসময় কূটনীতি পরিচালিত হতো আদর্শ নির্ভর নীতিতে। বর্তমান নীতিতে ফিরতি পথ ধরা সহজ, প্রয়োজন ফুরালেই উল্টো পথে হাঁটা শুরু করা যায়, তাগে তেমন দেখা যায়নি। বিশ্ব কূটনীতির নীতি বদল হয়েছে এ কথা যেমন সত্যি, বিশ্ব ব্যবস্থা আরো আন্তনির্ভরশীল হয়েছে এ কথাও সত্যি। এই বিবেচনায় আবারো সৈয়দ আশরাফকেই উদ্বৃত করতে হয়: বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক উন্নয়নে দু’দেশেরই লাভ। তবে বিশ্ব কূটনৈতিক নীতির বর্তমান রূপকে বিবেচনার বাইরে রাখা যাবে না। সম্পাদনা : পরাগ মাঝি