কুমিল্লায় ব্রাহ্মসমাজের শেষ নারী বংশধরের পরোলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন
প্রিয়াংকা আচার্য্য: বর্তমানে কুমিল্লায় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধিত্বকারী পরিবার রয়েছে কেবলমাত্র একটি। সে পরিবারেরই কনিষ্ঠ মেয়ে শ্রেয়সী সিংহ নয়না মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে মারা যান। তার বিদেহী আত্মার শান্তি প্রার্থনা করে মাঙ্গলিক উপাসনা শুক্রবার সকালে কুমিল্লা শহরের তালপুকুর পাড় তার পিত্রালয় সিংহ বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়।
প্রসঙ্গত শ্রেয়সী সিংহ ছিলেন কুমিল্লার ব্রাহ্ম সমাজের শেষ নারী বংশধর। তার পিতা অম্লান সিংহ ও মা কৃষ্ণা সিংহের ৩ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট মেয়ে। তিনি বিয়ে করেছিলেন হিন্দুধর্মানুসারী অনুপ সাহাকে। অর্ঘ্য নামে তাদের একটি ছেলেও রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা খুবই কম থাকায় বিয়ের জন্য তারা হিন্দু পাত্র-পাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছে। ফলে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে ব্রাহ্মধর্ম। অনুষ্ঠানে ব্রাহ্ম আচার্য্য দীপক পালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ব্রাহ্মদের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য। তিনি বলেন, হিন্দুধর্মের রীতিনীতির সঙ্গে ব্রাহ্মদের রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। হিন্দুদের মতো তাদের শবদেহ দাহ করলেও পারলৌকিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে তারা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করে না। ফলে হয় না কোনো যজ্ঞানুষ্ঠান। তবে মৃত্যুর ১৫ দিন পর তারা মাঙ্গলিক উপাসনার আয়োজন করে। এই ১৫ দিন তারা নিরামিষ খেয়ে থাকে যেখানে হিন্দুরা জাত বিভেদ অনুসারে ১১, ১৫ ও ৩০ দিনে শ্রাদ্ধকার্য করে। আর ঐ দিনগুলোতে মৃতের সন্তান ও স্ত্রী কেবল ফলাহার করে। উপাসনায় বেদ ও উপনিষদ থেকে কিছু শ্লোক পাঠের মাঝে মাঝে গাওয়া হয় রবীন্দ্র সংগীত। বর্তমানে মূলত রবীন্দ্র সংগীতগুলোই ব্রাহ্ম সংগীত হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এরপর পরিবার-পরিজন তার মৃতের শান্তি কামনা করে স্মৃতিচারণা করে উপাসনা শেষ করেন।
হিন্দুধর্মের অনেকটা সংস্কার রূপ এই ব্রাহ্ম ধর্ম। রাজা রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের হাত ধরে ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঈশ্বরকে ‘নিরাকার ব্রহ্ম’ রূপে উপাসনার জন্য এ ধর্মের নাম ব্রাহ্ম ধর্ম। ব্রাহ্ম ধর্মের মূলকথা: ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তিনি নিরাকার। ঈশ্বর বা এক ব্রহ্মের উপাসনা করাই ব্রাহ্ম ধর্মের আচরণীয় কর্তব্য। নারীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহ বিস্তারে ব্রাহ্মসমাজ কিংবদন্তী ভূমিকা পালন করেছে। বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু করে এ সমাজ। এছাড়া সতীদাহ প্রথা বিলোপ করে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান নারীদের রক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে।
১৮৪৩ সালের ২১ ডিসেম্বর কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের প্রথম দীক্ষাদান অনুষ্ঠানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্তসহ ১৯ জন তরুণ দীক্ষাগ্রহণ করেন। ঢাকায় ১৮৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ব্রাহ্ম মন্দিরের যাত্রা শুরু হয়। ঐ দিনই আনন্দ নন্দী পরবর্তীতে আচার্য মহারাজ আনন্দ স্বামী যিনি ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম প্রচারক ও সাধক পুরুষ তার ভাই কৈলাস নন্দীসহ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে কুমিল্লা, মেদিনীপুর, রংপুর, বাঁশবেড়িয়া, সুখসাগরসহ আরও কিছু জায়গায় মানুষ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মসমাজ গড়ে তোলেন। ব্রাহ্মরা হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিবিরোধী, তারা মূর্তিপূজাবিরোধী। তারা জাতিভেদ প্রথা মানেন না।
আচার্য্য আনন্দ স্বামীর প্রথম মেয়ে গুণময়ী দেবীর বিয়ে হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইলের গুরুদয়াল সিংহের সঙ্গে। গুরুদয়াল সিংহ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেয়ায় তাকে পিতৃপরিবার থেকে বিতাড়িত করা হলে তিনি সস্ত্রীক কুমিল্লা শহরে বসতি গড়েন। তার তৈরি ‘সিংহ মুদ্রাযন্ত্র’ ত্রিপুরা জেলার প্রথম ছাপাখানা। এই ছাপখানা থেকে ১৮৮৫ সালে সাপ্তাহিক ত্রিপুরা হিতৈষী পত্রিকা চালু হয়।
১৯২২ সালে গুরুদয়াল সিংহের ছেলে কমনীয় কুমার সিংহের মৃত্যুর পর এ পত্রিকার সম্পাদক হন ঊর্মিলা সিংহ। তিনিই ছিলেন এ অঞ্চলের প্রথম নারী সম্পাদক। পরবর্তীতে তার ছেলে অরুণ কুমার সিংহ এ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর এই অরুণ কুমার সিংহের নাতনি ছিলেন শ্রেয়সী সিংহ। ফলে তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে কুমিল্লায় ব্রাহ্ম সমাজের শেষ নারী বংশধরের অবসান ঘটে।