চীনের প্রেসিডেন্টের সফর ভূ-রাজনীতিতে নতুন উচ্চতায় বাংলাদেশ
উম্মুল ওয়ারা সুইটি: দীর্ঘ ৩০ বছর পর চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে যতটা লাভবান হয়েছে, তার চেয়ে বেশি এগিয়েছে ভূ-রাজনীতিতে। বিশ্বব্যাপী বহমান কূটনৈতিক মেরুকরণে বাংলাদেশ এখন কতটা গুরুত্বপূর্ণ শি জিনপিং-এর সফর তা প্রমাণ করে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বললেন, গত ত্রিশ বছরের মধ্যে চীনের মতো অর্থনৈতিক শক্তিশালী
একটি দেশের প্রেসিডেন্টের এটিই ছিল প্রথম সফর। ফলে এ সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ তো বটেই, গোটা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বইছে আলোচনার ঝড়। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে এ সফর কতটা ফলপ্রসূ হলো-দেশের অভ্যন্তরীণ সীমা ছাড়িয়ে তা আলোচিত প্রতিবেশীর পাশাপাশি পরাশক্তি দেশগুলোর মধ্যেও। কূটনীতিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে হিসাব করছে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। সেখানে উঠে এসেছে এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। ভারতের মতো চীনও এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেই সঙ্গে রয়েছে অপর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরও। সে জন্যই ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। তাই এবারের চীনের প্রেসিডেন্টের সফর আগের যেকোনো বারের চেয়ে অতিগুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলি শিকদার বলেন, চীনা প্রেসিডেন্টের এ সফরের মধ্যদিয়ে লাভ হলো যে, ভূ-রাজনৈতিকভাবে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ গুরুত্ব পেল। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য। ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। আবার এই তিন দেশের মধ্যে আলাদা আলাদা স্বার্থ রয়েছে। এই ত্রি-শক্তির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবগুলো রাষ্ট্রের কাছেই ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ অঞ্চলে প্রভাব রাখতে হলে বাংলাদেশকে লাগবে। চীন আগে কো-অপারেশনে ছিল, এখন স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হলো। এ সম্পর্ক অটুট থাকলে উভয় দেশই লাভবান হবে। আর যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তা হলে বাংলাদেশের পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সব বিবেচনায় চীনের এ সফরের মধ্যদিয়ে ভূ-রাজনৈতিক খেলায় আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। তবে সেটি নির্ভর করবে, এ সম্পর্ক কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, তার উপর।
এ ব্যাপারে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেন, শি জিনপিংয়ের সফরকালে কত টাকার চুক্তি হয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে নানাদিক থেকেই এ সফর উভয় দেশের জন্যই ভালো হয়েছে। লেনদেন ও সম্পর্কের নানা মাত্রার মধ্যদিয়ে উভয়ই একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠবে। চীন বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক ফ্রেন্ড। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাচ্ছেÑ এটা আশাব্যঞ্জক। আর বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রেখে এগোচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি বা মতভেদ হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, চীন ঋণ দেবে ঠিক আছে, কিন্তু শর্তগুলো কি হবে, পরিশোধের সময়সীমা কেমন হবে, এসব বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত কয়টি চুক্তি এবং কয়টি সমঝোতা স্মারক হয়েছে, তা জানা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। বাণিজ্য বাধা থাকলে তা দূর করতে হবে, নতুন পণ্য রপ্তানি করতে হবে। ভূ-রাজনীতির জন্য চীনের এ সফর ভালো হয়েছে’- বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘চীনা প্রেসিডেন্টের সফর ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটি সফল হয়েছে। এ সফরের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হলো।’ এ সফরে ঘুরেফিরে ভারত প্রসঙ্গটি আসছে। কিন্তু আমার মতে, এতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের সংকট হবে না। কারণ চীনের সঙ্গে সম্পর্কটা অর্থনৈতিক, আর ভারতের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক ও রাজনৈতিক। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের মধ্যদিয়ে শুধু চীনের সঙ্গেই নয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গেও উন্নয়ন ও সম্পর্ক কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়বে- বলেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। সম্পাদনা: আজাদ হোসেন সুমন