মানিকের পদ্মা নদীর মাঝি নিয়ে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’
ইমরুল শাহেদ : ভোরের কুয়াশা ছিন্ন করে এক দল মাঝি মাছ ধরার জন্য নদীর দিকে ছুটছে। এটাই তাদের জীবিকা। মাছ ধরা শেষ করে মাঝিরা যখন নদীর পাড়ের দিকে মহাজনদের কাছে আসে তখন নৌকার খোলে ফেলে রাখা রুপালি ইলিশের ওপর সূর্যের লাল আভা পড়ে চিকচিক আলোর ছ¦টা ছড়ায়। এভাবেই কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মানদীর মাঝিতে তুলে ধরেছেন পদ্মাপারের জেলে জীবনের ইতিবৃত্ত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাস রচিত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই তা শিল্পোত্তীর্ণ সাহিত্য হিসেবে খ্যাতি পেয়ে যায়। তাই ঢাকার চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন কালে নির্মিত উর্দু ধ্রুপদ চলচ্চিত্র ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (দ্য ডে শ্যাল ডন)-এর জন্য বেছে নেওয়া হয় কালজয়ী এই উপন্যাসকে। মুম্বাইতে অনুষ্ঠেয় জিও এমএএমআইয়ের ১৮তম চলচ্চিত্র উৎসব থেকে সম্প্রতি এই ছবিটিকে পাকিস্তানি ছবি বিবেচনায় বাদ দিয়েছে। তাতে কার লাভ বা কার ক্ষতি হয়েছে এই বিতর্কে না গিয়েও চলচ্চিত্র শিল্পের উন্মেষকালের প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ১৯৫৯ সালে নির্মিত একটি সিনেমার শৈল্পিক অগ্রগতি বা সেসময়ের সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত নান্দনিকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া থেকে বর্তমান দর্শককে যে বঞ্চিত করা হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ জে কারদার নির্মিত ৮৭ মিনিটের চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরায় কুবের মাঝি চরিত্রে অভিনয় করেন খান আতাউর রহমান, মালা চরিত্রে ভারতীয় অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। পরে ’৯০-এর দশকে গৌতম ঘোষও ‘পদ্মানদীর মাঝি’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রে কুবের মাঝি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদ, মালা চরিত্রে চম্পা এবং কপিলা চরিত্রে ভারতের রুপা গাঙ্গুলী।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি বিশ্বের ৩২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এর চলচ্চিত্রায়নের জন্য বলা হয়েছিল ‘দ্য রিভার’ খ্যাত নির্মাতা আঁন্দ্রে ওয়াজদাকে। তিনি এটি নির্মাণ করতে সাহস করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের ইলিশ সম্পর্কে আমার জানা নেই। এর ইথোজ (আত্মিক বিষয়) সম্পর্কেও জানি না। আর যেখানে সত্যজিৎ রায় রয়েছেন সেখানে এ ছবি বানাবার দুঃসাহস আমার নেই।’ পরে গৌতম ঘোষ এ ‘দুঃসাহস’ দেখালেও তার আগেই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এ জে কারদার। জাগো হুয়া সাভেরার জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ।
চিত্রনাট্য তো তৈরি হলো কিন্তু চিত্রগ্রহণ কে করবে? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায় ভোরে মাঝিরা যখন কুয়াশার আবরণ ভেদ করে নদীর দিকে ছুটে যায় তা যথাযথভাবে পর্দায় আনার মতো চিত্রগ্রহণ করার কেউ এ উপমহাদেশে নেই। শেষ পর্যন্ত হলিউড থেকে আনা হলো ওয়াল্টার লেসালিকে। তিনি এসব দৃশ্য চিত্রায়নের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেননি।
পদ্মানদীর মাঝি মূলত কুবের মাঝি, মালা ও কপিলার গল্প। কিন্তু এর সঙ্গে এসেছে একটি রহস্যময় চরিত্রÑ হোসেন মিয়া। হোসেন মিয়া চরিত্রটি বিশ্বসাহিত্যের বিরল চরিত্রগুলোর একটি। তার স্বপ্ন ছিল একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসটি রচনা করেছেন ১৯৩২ সালে। তখন এদেশে চলছে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আন্দোলন। গল্পের আখ্যানভাগে তুলে ধরা হয়েছে মানবিক সংকটকে। ইংরেজ লেখক ফ্রয়েড ছিলেন মানিকের প্রিয়। তাই ঘুরেফিরেই তার সাহিত্যে এসেছে পরকীয়া। কুবের মাঝির বিবাহিত স্ত্রী মালা। কিন্তু তাকে তার ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে শ্যালিকা কপিলাকে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি এই মানবিক সংকটকে তুলে আনা হয়েছে অতীব মুনশিয়ানার সঙ্গে। এই ছবিটি বাংলা ভাষায় নির্মিত বিদেশি ছবি হিসেবে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে অংশ নেয় এবং মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নেয় গোল্ডেন মেডেল। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী