বিশ্বের ৮০ ভাগ পরচুলার বাজার ভারতের দখলে, আয় বিলিয়ন ডলার
রাশিদ রিয়াজ : ভারতের মন্দিরে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী নারীদের মাথার চুল কেটে ফেলার পর তা পরচুলাসহ বিভিন্ন পণ্যে রুপান্তরিত করে রপ্তানিতে দেশটির উদ্যোক্তরা বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। ভারত দীর্ঘদিন ধরেই এধরনের ফেলে দেয়া চুল রপ্তানি করে আসছে ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকাসহ নানা দেশে। তবে আফ্রিকা হচ্ছে ভারতীয় চুল রপ্তানির প্রধান বাজার। আবার চীন ভারতের চুল রপ্তানির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। অথচ প্রথম দিকে ভারত চীনে চুল রপ্তানির পর তা দিয়ে অ্যামাইনো এসিড তৈরি করা হতো। কিন্তু এখন পরচুলা হিসেবে সারাবিশ্বে এধরনের চুলের ব্যবহার হচ্ছে বেশি। বাংলাদেশ থেকেও চুল রপ্তানি করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে।
ভারতে মন্দিরগুলোই রপ্তানিকারকদের কাছে চুল সংগ্রহের প্রধান উৎস। দক্ষিণ ভারতের তিরুমালার ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির থেকেই বছরে ৭৫ টনের বেশি চুল সংগ্রহ করা হয়। জেরুজালেম, রোম ও মক্কায় (হজের সময়) মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারিরা যে পরিমাণ চুল কাটেন তারচেয়েও বেশি চুল সংগ্রহ হয় ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির থেকেই। অন্তত ১৮ মিলিয়ন তীর্থযাত্রী প্রতিবছর ওই মন্দিরে অবতার বিষ্ণুর পুজো করতে এসে মাথার চুল কামিয়ে ফেলেন সমাজে সবধরনের ভাল কাজ রক্ষার কামনায়। সুসন্তান লাভের আশায় মন্দিরে প্রার্থনা করতে এসে অনেক নারী চুল ফেলে দেন। এসময় দিনে অন্তত ১২ হাজার তীর্থযাত্রীর চুল কাটতে শশব্যস্ত হয়ে পড়ে নাপিতরা।
সংগৃহীত চুলের মধ্যে আকার ও গুণে চারটি ভাগ করা হলেও লম্বা ও পাকা চুলের কদর সবচেয়ে বেশি। কারণ পাকা চুল বিভিন্ন রঙ দিয়ে পরচুলায় পরিণত করা হয়। তাই বলে পুতুল, ব্রাশসহ অন্যান্য শিল্পে খাটো চুলের কদর কম নয়। ভারতে চুলের যতেœ বিভিন্ন পণ্য নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম গোদরেজ দক্ষিণ আফ্রিকায় ফ্রিসকা হেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে বিশাল বিনিয়োগ করেছে বহু আগেই। এছাড়া মারিকো, ডাবুর ও ভিএলসিসি অনেক আগেই চুল ও এর যতেœ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে দক্ষিণ আফ্রিকা, মরক্কো ও নাইজেরিয়ায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে।
ভারতীয় চুল শক্ত, মজবুত, প্রাকৃতিকভাবেই উঁচু মানের হওয়ায় বিশ্ববাজারে সহজে তা নজর কেড়েছে। বিলিয়ন ডলারের এ রপ্তানির বাজার প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে ১০ থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে ভারতে চুলের অনলাইন অকশন হয়। অসংখ্য অনলাইন প্রতিষ্ঠান চুলের তৈরি বিভিন্ন পণ্য, এর ব্যবহার ও সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত তথ্যচিত্র দিচ্ছে।
যে আফ্রিকায় চুলের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ ভারত, ওই মহাদেশের বিভিন্ন দেশে চুলের বাজারের আকার হচ্ছে ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তাই ইউনিলিভার ও এল’অরেল’-এর মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে বিনিয়োগ করতে পিছপা হয়নি।
ভারতে চুলের আরেক বড় সংগ্রহ এলাকা হচ্ছে চেন্নাই। গত ৫ দশক ধরে চেন্নাইয়ে অন্তত ২শটি প্রতিষ্ঠান চুল রপ্তানি করে আসছে। চেন্নাইয়ের মাঝারি ধরনের একটি চুল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নন্দলালা এন্টারপ্রাইজ ১০টি দেশে প্রায় ৫ টন চুল রপ্তানি করে। এ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কে শ্রিজা জানান, বছরে তার প্রতিষ্ঠান অন্তত কুড়ি হাজার নারীর চুল সংগ্রহ করে তা রপ্তানি করে। তিনি জানান, একজন নারীর মাথা থেকে অন্তত ২শ গ্রাম চুল সংগ্রহ করা যায়। মন্দির থেকে চুল সংগ্রহ করার পর শ্যাম্পু দিয়ে বেশ কয়েকবার ধুয়ে তাতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক যৌগ, রঙ ও উপকরণ ব্যবহার করে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। এরপর চলে পরচুলা থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ তৈরির কাজ।
বিশ্বে চুলের বাজারে চাহিদার ৮০ ভাগ পূরণ করে ভারত। জাতিসংঘের এক হিসেবে ভারত বছরে চুল রপ্তানি করে ১৩শ টনেরও বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে ১শ গ্রাম ভারতীয় চুলের মূল্য দেড়শ ডলার হলেও চীন সমপরিমাণ চুল বিক্রি করে মাত্র ৩০ ডলারে। নামিবিয়ায় চুলের এক ব্যবসায়ী সান্দ্রা আবেল জানান, চীনের তৈরি পরচুলা একবার ধুলে তা ফের ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে যেখানে ভারতীয় পরচুলা ব্যবহার করা সম্ভব হয় দুবছর পর্যন্ত। বিবিসি। সম্পাদনা: ফারুক